
অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একজন আইনপ্রণেতা আবিজেইল সেলিনা বয়েড। তিনি সংসদে বাংলাদেশ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। শেখ হাসিনার আমলের দুঃশাসন ও হত্যাকাণ্ড তুলে ধরেছেন তিনি। তিনি ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে নির্বাচনেরও দাবি তুলেছেন।
অস্ট্রেলিয়ার এই আইনপ্রণেতা সংসদের সভাপতির উদ্দেশে বলেন, আমি নোটিশ দিচ্ছি যে, আগামী অধিবেশন দিবসে আমি নিম্নলিখিত প্রস্তাব আনব—এই সংসদ গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করে যে, ১৭ বছর ধরে বাংলাদেশের জনগণ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন স্বৈরশাসনের অধীনে ছিল, যা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণতন্ত্রের দমন এবং নির্বাচনী জালিয়াতির মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি ছাত্র আন্দোলনের ফলে দেশব্যাপী বিক্ষোভ শুরু হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার পতিত হয় এবং আগস্ট ২০২৪ সালে হাসিনা দেশত্যাগ করেন।
তিনি বলেন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, রয়টার্স এবং জাতিসংঘের তথ্যানুসারে, এই বিক্ষোভের সময় ২ হাজার ৭৩২ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। ৩০ হাজারের বেশি আহত হয়েছেন এবং অন্তত ৩৯ জন শিশু প্রাণ হারিয়েছে। এই নৃশংসতা, পাশাপাশি ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে সংঘটিত ‘মনসুন বিপ্লব’ গণহত্যায় হাজারো মানুষের মৃত্যুর ঘটনা, বিগত ১৭ বছরের দমনমূলক শাসনের প্রতিফলন, যেখানে রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম এবং সাংবাদিক, কর্মী ও বিরোধী নেতাদের উপর নির্যাতন চালানো হয়েছে।
‘হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা চরমভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন ব্যাপক ভোট জালিয়াতি, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং কারসাজির কারণে আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিত হয়েছে। ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তির ফলে নির্বাচন ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়, যার ফলে সরকার প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্মূল করে কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখে,’ বলেন মিসেস বয়েড।
তিনি বলেন, ‘র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) একটি আধাসামরিক বাহিনী। বাহিনিটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম এবং নির্যাতনের সাথে জড়িত। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে র্যাবের হাতে ২,৬৯৯ জনের বেশি মানুষ অবৈধভাবে নিহত হয়েছে এবং এই বাহিনী সম্পূর্ণ দায়মুক্তি নিয়ে কাজ করে বিরোধী দল ও ভিন্নমতাবলম্বীদের আতঙ্কিত করেছে।
অস্ট্রেলিয়ার এই আইনপ্রণেতা আরও বলেন, ‘হাসিনা প্রশাসনের অধীনে বিচার ব্যবস্থা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন, সমালোচকদের কারাবন্দি করা এবং সরকার-সমর্থকদের রক্ষা করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। বিচারকদের পক্ষপাতিত্ব, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো কঠোর আইন প্রয়োগ করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা দমন করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে দুর্বল করেছে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকায় দেশটি গুরুতর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, যার মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক হুমকি, দুর্নীতি এবং অস্থিতিশীলতা। জাতিসংঘের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরকে সহায়তা করা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে—নির্বাচনী সংস্কারের জন্য কারিগরি সহায়তা ও পর্যবেক্ষণ প্রদান, মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য সাবেক সরকারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যাতে আরেকটি স্বৈরাচারী শাসনে পরিণত না হয়, তা নিশ্চিত করা যায়।
তিনি আরও বলেন, ‘এই সংসদ গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে এবং বাংলাদেশের জনগণের জাতীয় সার্বভৌমত্ব, স্থিতিশীলতা ও ন্যায়বিচারের সংগ্রামের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে, যা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনে ফিরে যাওয়ার ওপর নির্ভরশীল।’
আইনপ্রণেতা আরও বলেন, ‘এই সংসদ অস্ট্রেলিয়া সরকারকে আহ্বান জানায় যে, তারা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে—মনসুন বিপ্লব গণহত্যার শিকারদের জন্য ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করুক, যাতে জনগণ সত্য, বিচার ও ক্ষতিপূরণ পায় এবং অবিলম্বে একটি নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করুক। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে অবাধ, সুষ্ঠু ও আন্তর্জাতিকভাবে পর্যবেক্ষণকৃত একটি নির্বাচন সম্পন্ন হোক। এই সরকারের মাধ্যমে কঠোর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাসহ একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন, সকল রাজনৈতিক দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা এবং নির্বাচনী স্বচ্ছতা পুনরুদ্ধার করা হবে যাতে ভবিষ্যতে কারচুপি ও অস্থিতিশীলতা রোধ করা যায়।
তিনি আরও বলেন, ‘র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) অবিলম্বে বিলুপ্ত করুক এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম এবং নির্যাতনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনুক, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর স্বাধীন তদন্ত ও আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করুক, এবং মানবাধিকার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে একটি পুনর্গঠিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করুক।
অস্ট্রেলিয়ার এই আইনপ্রণেতা আরও বলেন, ‘বিচার ব্যবস্থার রাজনৈতিক অপব্যবহার বন্ধ করুক, যার মাধ্যমে—বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে এবং বিচারক নিয়োগ ও রায় প্রদানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ দূর করা হবে। বিরোধী নেতা, সাংবাদিক ও কর্মীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা পর্যালোচনা করে বাতিল করা হবে এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো কঠোর আইন বাতিল বা সংস্কার করা হবে যাতে এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করুক, যার মাধ্যমে—একটি স্বচ্ছ ও স্বাধীন দুর্নীতি দমন সংস্থা গঠন করে আগের সরকারের আর্থিক অনিয়ম তদন্ত করা হবে, অর্থ আত্মসাৎ, মানি লন্ডারিং এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের সাথে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা হবে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি দূর করে জনসাধারণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে।