দীর্ঘ প্রায় আড়াই দশকের জোট শরিক বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে চলছে কথার লড়াই। এ লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছেন দল দুটির শীর্ষ নেতারা। গতকাল রোববার জামায়াতের সাম্প্রতিক কার্যক্রমের কড়া সমালোচনা করেছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। জামায়াত এ নিয়ে পাল্টা বিবৃতি দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজেদের পেজে বিষয়টি নিয়ে পাল্টাপাল্টি পোস্ট দিচ্ছেন দল দুটির কর্মী-সমর্থক।
১৯৯৯ সালে চার দলীয় জোট গঠিত হয়। এ জোটের প্রধান দুটো দল ছিল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। দল দুটি ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায়ও আসে। এর পর আবার বিরোধী দলে যায়। চার দলীয় জোট থেকে ২০ দলীয় জোট হয়। শেখ হাসিনার শাসনের শেষদিকে দল দুটির মধ্যে দূরত্ব দেখা দেয়। গত কয়েক বছর ধরেই নানা বিষয়ে টানাপোড়েন চলছে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সভা-সমাবেশের বক্তব্য-বিবৃতিতে মন্তব্য ছোড়াছুড়ি চলছে। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর এই বিরোধ আরও প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।
গতকাল জামায়াতে ইসলামীর সাম্প্রতিক কার্যক্রমের কড়া সমালোচনা করেছেন রুহুল কবির রিজভী। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি বলেন, শেখ হাসিনার আমলে ব্যাংক লুটকারী এস আলমদের উত্তরসূরি হয়েছে অনেকে। বড় বড় কথা বলে বিএনপির নামে কলঙ্ক লেপন করছে। টেন্ডারবাজি, পাড়া-মহল্লায় টার্মিনালসহ নানা কিছু দখল করেছে একটি দল। পায়ের রগ কারা কাটে– তাদের চেনে জনগণ।
জামায়াত নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ইসলাম নিয়ে রাজনীতি করেন। ইসলাম মানে তো মোনাফেকি করা না। একটি দল নিজেরা মোনাফেকি করছে আর বিএনপিকে সবক দিচ্ছে; কলঙ্ক লেপনের চেষ্টা করছে। শেখ হাসিনার সঙ্গে আঁতাত করে সেদিন আপনারা এরশাদ কুলাঙ্গারের নির্বাচনে যাননি? আপনাদের একাত্তরের অর্জন কী? আপনারা একাত্তরের বিরোধিতা করেছেন।
রিজভীর বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান গতকাল এক বিবৃতি বলেছেন, রিজভীর বক্তব্য বিভ্রান্তিকর, ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। জামায়াতের রাজনীতি ভারতের আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। এ ভূমিকা জাতি গ্রহণ করেছে। এ কারণেই সম্ভবত রিজভীর গাত্রদাহ হয়েছে। এ ধরনের বিভ্রান্তিকর ও অপবাদের রাজনীতি থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।
রফিকুল ইসলাম বলেন, জামায়াত রগকাটা ও ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের রাজনীতি কখনও করেনি। জামায়াত ‘ইসলাম’ নিয়েও রাজনীতি করে না। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত জোটকে এড়িয়ে ভিন্নমতের সঙ্গে জোট গড়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে ঐক্য বিএনপি করেছিল, তা কি জাতির সঙ্গে মোনাফেকি নয়?
গতকাল রাতে বিএনপির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জামায়াতের বিবৃতির স্ক্রিনশট এবং জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমানের ২০১৮ সালের একটি নির্বাচনী পোস্টার দিয়ে তৈরি ফটোকার্ড পোস্ট করা হয়েছে। পোস্টের ক্যাপশনে লেখা– ‘২০১৮ সালের নির্বাচনে জামায়াত দর কষাকষি করে ২২ আসন বাগিয়ে নেয় জোট থেকে এবং সে নির্বাচনে ডা. শফিকুর রহমান নিজেও ধানের শীষ প্রতীকে প্রার্থী হয়েছিলেন। তাহলে কার সাথে জোট? আর কার সাথে মোনাফেকির কথা বললেন আমির?’
এই পোস্টের ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ১৭ হাজারের বেশি প্রতিক্রিয়া ও সাড়ে ছয় হাজার মন্তব্য করা হয়েছে। এ ছাড়া পোস্টটি শেয়ার করেছেন প্রায় তিন হাজার ব্যবহারকারী। মন্তব্যে দুই দলের কর্মী-সমর্থকরা পাল্টাপাল্টি সমালোচনা করেছেন।
১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে বিএনপি, জাতীয় পার্টি (এরশাদ), জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট নিয়ে চার দলীয় জোট গঠিত হয়। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল চার দলীয় জোটের কলেবর বেড়ে হয় ২০ দলীয় জোট। আওয়ামী লীগের আমলে স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দুই দলের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। ২০২২ সালের আগস্টে জামায়াতের মজলিসে শূরার একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দলটির আমির শফিকুর রহমান বলেন, ২০ দলীয় জোট আর কার্যকর নেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ২০২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘পরকীয়া’ করছে জামায়াত।
জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিভিন্ন বক্তব্যে বলেন, তাদের যে জোট ছিল, আন্দোলনের জন্য জোট; সেটা অনেক আগেই অকার্যকর হয়ে গেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর দল দুটির মধ্যে প্রথম বিরোধ দেখা দেয় বর্তমান সরকারের মেয়াদ নিয়ে। এর পর সংবিধান সংস্কার, নির্বাচন নিয়েও মতপার্থক্য দেখা যায় বিএনপি ও জামায়াতের নীতিনির্ধারকদের কথায়।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু জামায়াতের সমালোচনা করে বলেন, কিছু দল আছে; আমাদের সঙ্গে থাকলেও ১৯টা সিট পায়। আমাদের থেকে বেরিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকলে তিনটা সিট পায়। তারা ভোট তো ভয় পাবেই। এটা অস্বাভাবিক কিছু না।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম