রাষ্ট্রের ধারণার প্রবক্তা প্লেটো আমাদের রাজনীতির লক্ষ্য প্রদানের জন্য সঠিক ব্যক্তি। তিনি যখন তাঁর অনবদ্য রচনা 'দ্য রিপাবলিক'-এ তার আদর্শ রাষ্ট্রকে ন্যায়বিচার, সম্প্রীতি এবং এর নাগরিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করার বিষয় হিসাবে চিত্রিত করেন তখন আমরা মানুষের কল্যাণ বৃদ্ধি করাকেই রাজনীতির লক্ষ্য হিসেবে বের করে আনতে পারি।
প্রকৃতপক্ষে, প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণাটি এখনও সমসাময়িক ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একজন দার্শনিক-রাজাকে তার আদর্শ রাষ্ট্রতত্ত্বে অবশ্যই একজন আলোকিত শাসক হতে হবে যার রাষ্ট্রীয় বিষয়ে গভীর জ্ঞান এবং পরম সত্য ও ন্যায়বিচার বোঝার ক্ষমতা থাকতে হবে।
তবে আধুনিক সময়ে কেউ 'রাজা' এবং 'শাসক' শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে তার সতর্কতা প্রকাশ করতে পারে। শব্দ যাই হোক না কেন, অভ্যন্তরীণ অর্থ একই থাকে এবং প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা থেকে যা দাঁড়ায় তা হল, জনগণের মঙ্গলই রাজনীতির চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত। তবে রাজনীতি যখন পারিবারিক রাজবংশের দ্বারা প্রভাবিত হয় বা রাষ্ট্র যদি পুঁজিবাদের দোস্তিতে/ক্রোনিতে ভোগে, মানুষের মঙ্গল তখন হ্রাস পেতে দেখা যায়।
এই আধুনিক বিশ্বে যে ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর জন্ম হয়েছে সেগুলো হল-শিল্প বিপ্লব, ম্যাগনা কার্টা, ইংল্যান্ডের গৌরবময় বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রণীত বিল অফ রাইটস এবং রুশ বিপ্লব। এই সমস্ত ঘটনার সারমর্ম হলো জনগণের ক্ষমতায়ন এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজতন্ত্র (একটি পরিবারে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা) থেকে গণতন্ত্রে (জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য) রূপান্তর। কেন এই উত্তরণ ঘটল? উত্তর হল জনগণের স্বার্থ বজায় রাখা—মানুষের মঙ্গল সর্বাধিক করা। এর মানে হল যখন ক্ষমতা এক পরিবারের হাতে দখল করা হয়, তখন মানুষের মঙ্গল কখনই সর্বাধিক হয় না। আর এই কারণেই জনগণ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল যাতে রাষ্ট্র যেসব সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে পারে, জাতি এবং ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়- যাতে লোকেরা পছন্দ আর উদ্যোগের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে এবং এইভাবে নিজেদের মঙ্গল সর্বাধিক করতে পারে।
যেসব রাজ্যে এই সমস্ত বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল, সেখানে উত্তরণের পরে জনগণের কল্যাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পেছনের কারণ অমর্ত্য সেনের উন্নয়নের প্রতি সক্ষমতার দৃষ্টিতে ব্যক্তির সামর্থ্যের বিকাশ সামগ্রিক মানব উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। 'ক্ষমতা বৃদ্ধি' -এর অর্থ মানুষের মধ্যে বিদ্যমান সম্ভাবনাগুলিকে কাজে লাগানো। যদি ব্যক্তির সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয় তবে তারা যে কোনও কিছু করতে সক্ষম হবে। ব্যক্তিদের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে, রাষ্ট্রকে অবশ্যই দারিদ্র্য দূরীকরণ, স্কুলের শিক্ষা ইত্যাদির মত প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থার করে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কিন্তু যেসকল রাষ্ট্রে এক পরিবারের কাছে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় বা যেখানে পুঁজিবাদের দোস্তি বিদ্যমান সেখানে ব্যক্তির সক্ষমতা বাড়ানো যায় না, অর্থাৎ মানুষের সম্ভাবনা অব্যবহৃত থেকে যায়।
এই প্রেক্ষাপটে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে, মানুষ অন্যের কাছ থেকে ভিক্ষা গ্রহণ করা উপভোগ করে না, আর তা ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে হোক না কেন। তারা তাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়, নিজস্ব প্রচেষ্টা চালাতে চায়, তাদের নিজস্ব উদ্যোগ গড়ে তুলতে চায় এবং তারপরে তাদের রুটি নিজেই উপার্জন করতে চায়। তারা 'রাজকীয় পরিবার' থেকে করুণার বস্তু হওয়া উপভোগ করে না। মানব প্রকৃতির এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অমর্ত্য সেনের সক্ষমতা পদ্ধতিতে 'সক্ষমতা বৃদ্ধি' প্রয়োজনীয়তাকে আহ্বান করা হয়েছে।
একটি পারিবারিক রাজবংশের অস্তিত্ব শুধুমাত্র 'ব্যক্তি পূজা' বা 'ব্যক্তিত্বের ধর্ম' নামক একটি মনস্তাত্ত্বিক 'রোগ'-এর উপর নির্ভরশীল যা বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশগুলিতে দেখা যায়। যেখানকার অশিক্ষিত লোকেরা তাদের 'নায়ক'-এর পরিবারের সদস্য বা বংশধরদের নিজেদের থেকে উচ্চতর মনে করে। মানুষ একবার কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির 'পূজা' শুরু করলে, তারা বংশ পরম্পরায় তার বংশধরদের 'পূজা' করতে থাকে।
শেখ মুজিবুর রহমান এবং জেনারেল জিয়াউর রহমানের পরিবার বাংলাদেশে এরকম দুটি রাজবংশ। যেমনটি ইতোমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পারিবারিক রাজবংশ দ্বারা কলুষিত একটি রাষ্ট্রে কল্যাণের মাত্রা কম দেখা যায়। তবে নৈতিক বিষয়গুলি আরও গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তি, তা সে কৃষক পরিবারের কেউ হোক বা ধনী পরিবারের কেউ হোক, রাষ্ট্রের সিঁড়ির শীর্ষে পৌঁছানোর সক্ষম থাকা উচিত। পারিবারিক রাজবংশ প্রত্যেক ব্যক্তির এই ধরনের উত্থানের পথে একটি চূড়ান্ত বাঁধা। অর্থাৎ পারিবারিক রাজবংশ একটি বৈষম্যমূলক, অন্যায্য ও অন্যায় সমাজের সৃষ্টি করে। যেহেতু বাংলাদেশে সাম্প্রতিক আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার শাসনকে উৎখাত করাকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন বলা হচ্ছে, তাই আমরা আশা করব বর্তমানে আধুনিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা পারিবারিক রাজবংশ বিলুপ্তির বিষয়টি গ্রহণ করবে।
ভারতে কংগ্রেস পার্টির সভাপতি হিসাবে দীর্ঘ মেয়াদের কারণে জওহরলাল নেহেরু ভারতীয় জনগণের মধ্যে ব্যক্তিগত প্রশংসার বিষয় হয়ে ওঠেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা মহাত্মা গান্ধী এই ধরনের ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা থেকে আরও বেশি উপকৃত হয়েছেন। নেহেরু কখনই তাঁর কন্যা ইন্দিরাকে নেতৃত্বের জন্য মনোনীত না করলেও তিনি (ইন্দিরা) লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর অনুসরণে প্রথমে কংগ্রেস প্রধান এবং পরে প্রধানমন্ত্রী হন। কংগ্রেস পার্টির বেশিরভাগ সমর্থক নেহেরু পরিবারের একজন সদস্যকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য পছন্দ করেন, যদিও সেই ব্যক্তির যোগ্যতা কম ছিল। উদাহরণস্বরূপ, যখন ইন্দিরা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন তখন কংগ্রেসে জগজীবন রামের মতো নেতা ছিলেন যারা যোগ্যতায় ইন্দিরা গান্ধীর চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য ছিলেন।
ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর কংগ্রেসে প্রণব মুখার্জি এবং নরসিমা রাওসহ অনেক প্রতিভাবান নেতা থাকা সত্ত্বেও ইন্দিরার পুত্র রাজীব গান্ধী ছিলেন প্রথমে কংগ্রেসের সভাপতি এবং তারপর দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। পরে এক পর্যায়ে দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদে ছিলেন মা-ছেলের জুটি সোনিয়া গান্ধী ও রাহুল গান্ধী। বিষয়টিকে রাজবংশীয় রাজনীতির প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে এবং আধুনিক মূল্যবোধসম্পন্ন কংগ্রেস সদস্য এতে লজ্জিত বোধ করতে পারেন।
বাংলাদেশের অবস্থা ততটা খারাপ নয়। এখানে উভয় প্রধান দলে কমপক্ষে সাধারণ সম্পাদকের পদটি "সদয়ভাবে" "রাজপরিবারের" বাইরের কাউকে দেওয়া হয়। তবে আমাদের বংশবাদী রাজনীতির কবল থেকে মুক্ত হতে হবে। আধুনিক মূল্যবোধ এবং প্রগতিশীল মানসিকতার শিক্ষার্থীরা আমাদের এই লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করতে পারে।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের জন্য একটি আশীর্বাদ যা আমাদের এক বিস্ময়কর উত্তরণে সাহায্য করেছে। এখন ছাত্ররা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে এবং পারিবারিক বংশের বোঝা থেকে মুক্ত করতে আমাদের সাহায্য করতে পারে । যারা ইতোমধ্যে পড়াশোনা শেষ করেছেন তারা হয়তো এই নতুন রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারেন এবং অন্যরা অপেক্ষায় থাকতে পারেন। তারা অন্যদেরও তাদের দলে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানাতে পারে যারা জ্ঞান, সততা এবং দেশপ্রেমের পরিপ্রেক্ষিতে সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। যদি তারা সত্যিই এটি করার চেষ্টা করে তবে তাদের দুটি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। প্রথমত, তাদের একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে প্লেটোর ধারণা বিবেচনা করতে এবং তারপর একটি নতুন রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। প্লেটো একটি মেধাতান্ত্রিক সমাজের পক্ষে ছিলেন যেখানে ব্যক্তিদের তাদের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বা অর্জিত অবস্থার পরিবর্তে তাদের নিজস্ব ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে ভূমিকা এবং দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। শিক্ষা একটি আদর্শ রাষ্ট্রের নাগরিক গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। শিক্ষা কঠোর দার্শনিক প্রশিক্ষণ, গণিত, নীতিশাস্ত্র এবং শারীরিক সুস্থতার উপর গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে যার লক্ষ্য ছিল মানুষের বুদ্ধি ও নৈতিক চরিত্রকে লালন করা।
দ্বিতীয়ত, সমতার নীতি প্রস্তাবিত রাজনৈতিক দলের মূল চেতনা। আমাদের মনে রাখতে হবে সম্পদের সামাজিক মালিকানা ছাড়া মানুষের মুক্তি সম্ভব নয়, যার জন্য আমাদের সমাজে যৌথ জীবনের চেতনা গড়ে তুলতে হবে। আমাদের অবশ্যই এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যা সম্মিলিত জীবনের চেতনা শেখায়।
এক সময় বহু দেশে রাজতন্ত্রের দুর্গ ভেঙ্গে ফেলার বিপ্লব হয়েছিল। পারিবারিক রাজবংশকে ধ্বংস করার জন্য আজ আধুনিক বিশ্বের আরেকটি বিপ্লব দরকার। সেই বিপ্লব শুরু হোক বাংলাদেশ থেকে!
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক