
দেশজুড়ে ফিরে এসেছে শান্তি, ঐক্য আর সংস্কৃতির বার্তা নিয়ে রৌদ্রকরোজ্জ্বল বৈশাখী দিন। আজ সোমবার (১৪ এপ্রিল) বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-এর প্রথম দিন। জাতি, ধর্ম ও সংস্কৃতি নির্বিশেষে দেশের সব মানুষ আজ নতুন বছরকে বরণ করছে নানা আয়োজনে, সুর-সংগীত, লোকজ মেলা, রঙিন শোভাযাত্রা এবং সংস্কৃতির ঐতিহ্য ধারণ করে। নববর্ষের আনন্দ শোভাযাত্রা, সুর-সংগীত আর লোকজ মেলায় উৎসবমুখর হবে চারপাশ। নববর্ষকে আবাহন জানিয়ে বহুকণ্ঠে ধ্বনিত হবে ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো...।’
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর এবার নতুন পরিবেশে বর্ষবরণ উৎসব বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য তাই ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’। মূল প্রতিপাদ্য সামনে রেখে জাতীয়ভাবে রাজধানীসহ সারা দেশে ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে নববর্ষ উদ্যাপনের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে বলে আগেই জানিয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়।
প্রভাতেই ঢাকার রমনার বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনে রাগ ভৈরবীতে ‘মুক্তির গান’ দিয়ে শুরু হয় বর্ষবরণের প্রভাতি অনুষ্ঠান, যেখানে আলোর পথে মানুষকে আহ্বান জানানো হয়েছে। এবারের আয়োজনে নেই ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সঞ্জীদা খাতুন, যাঁর শূন্যতা অনুভব করেছে সবাই। প্রায় দেড় শতাধিক শিল্পীর পরিবেশনায় এ আয়োজন হয়ে উঠেছে বাঙালির মাটির সুর ও মানবপ্রেমের এক উজ্জ্বল প্রকাশ।
বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বাণী দিয়েছেন। ওই বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘আসুন, আমরা বিগত বছরের গ্লানি, দুঃখ-বেদনা, অসুন্দর ও অশুভকে ভুলে গিয়ে নতুন প্রত্যয়ে, নতুন উদ্যমে সামনের দিকে এগিয়ে চলি। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান আমাদের সামনে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার সুযোগ এনে দিয়েছে।’
পাহাড় ও সমতলের সব জনগোষ্ঠী এবার একসঙ্গে বৈশাখী উত্সবে অংশ নিচ্ছেন। বর্ষবিদায়ে পাহাড়ে উত্সবের আমেজ লেগেছে আগেই। গতকাল রাজধানীতেও ছিল চৈত্রসংক্রান্তির নানা আয়োজন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সরকারি উদ্যোগে আয়োজিত বর্ষবিদায়ের কনসার্টে গান গেয়েছে পাহাড় ও সমতলের বেশ কয়েকটি ব্যান্ডদল।
আজ ভোর থেকে সারা দেশে ব্যাপক আনন্দ-উদ্দীপনায় উদযাপিত হবে নববর্ষের প্রথম দিন। যে যার মতো করে যোগ দেবেন নানা অনুষ্ঠানে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ আয়োজিত ‘নববর্ষের আনন্দ শোভাযাত্রা’ এবার আরও বৈচিত্র্যময়। আগের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র জায়গায় নতুন নাম ও নতুন প্রেরণায় এটি রূপ পেয়েছে এক অনন্য সাংস্কৃতিক মিলনমেলায়। শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছেন পাহাড় ও সমতলের ২৮টি জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা, যাঁরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও প্রতীক নিয়ে হাজির হন। আয়োজনের প্রতিপাদ্য ছিল—‘নববর্ষে ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’, যা দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রতিফলন।
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে শুরু হয়েছে বৈশাখী মেলা, যা চলবে ৭ বৈশাখ পর্যন্ত। একইসঙ্গে একাডেমির নজরুল মঞ্চে চলেছে সংগীত, বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দিনভর বিভিন্ন জায়গায় চলছে ভ্রাম্যমাণ মঞ্চ, লোকসংগীত, আবৃত্তি, নৃত্য, ব্যান্ড শো এবং চীনা প্রযুক্তির ড্রোন শো।
বাংলা নববর্ষের উৎসব আজ শুধু রাজধানীতেই নয়, ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশ ও প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যেও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেসব অনুষ্ঠানের লাইভে দেশবাসী পাচ্ছেন এক অভিন্ন উৎসবের স্বাদ। রাষ্ট্র, সংস্কৃতি আর সমাজে এই উৎসব এখন আর কেবল একটি দিন নয়—এটি হয়ে উঠেছে জাতীয় ঐক্যের এক গর্বিত প্রতীক।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম