বৃহস্পতিবার,

০৩ এপ্রিল ২০২৫,

১৯ চৈত্র ১৪৩১

বৃহস্পতিবার,

০৩ এপ্রিল ২০২৫,

১৯ চৈত্র ১৪৩১

Radio Today News

বাংলাদেশ নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন বিভ্রান্তিকর: প্রেস উইং

রেডিওটুডে রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২২:৩৩, ১ এপ্রিল ২০২৫

Google News
বাংলাদেশ নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন বিভ্রান্তিকর: প্রেস উইং

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং আজ বলেছে, নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ নিজেকে পুনরুজ্জীবিত করছে, ইসলামী কট্টরপন্থীরা একটি উন্মোচন দেখছে’ শীর্ষক নিবন্ধটি বিভ্রান্তিকর। 

প্রেস উইং তার যাচাইকৃত ফেসবুক পেজ-সিএ প্রেস উইং ফ্যাক্টস-এ পোস্ট করা এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘নিউ ইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধটি বাংলাদেশের একটি বিভ্রান্তিকর ও একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে দেশটি ধর্মীয় চরমপন্থীদের নিয়ন্ত্রণের দ্বারপ্রান্তে’।

এই বয়ান কেবল দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক গতিশীলতাকে অতিরঞ্জিত করে না বরং ১৮ কোটি মানুষের একটি সমগ্র জাতিকে অন্যায়ভাবে কলঙ্কিত করার ঝুঁকির মুখেও ফেলে দেয়। 

বিবৃতি বলা হয়, একটি বিভ্রান্তিকর চিত্র তুলে ধরার মতো বেছে বেছে উস্কানিমূলক উদাহরণের উপর নির্ভর করার পরিবর্তে বিগত বছরে বাংলাদেশের অগ্রগতি ও পরিস্থিতির জটিলতা স্বীকার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিবৃতিটি নিম্নরূপ :

১. বাংলাদেশের অগ্রগতি এবং চ্যালেঞ্জগুলো স্বীকার করা :

নিবন্ধটিতে ধর্মীয় উত্তেজনা ও রক্ষণশীল আন্দোলনের কিছু ঘটনা তুলে ধরা হলেও অগ্রগতির বৃহত্তর প্রেক্ষাপটকে উপেক্ষা করা হয়েছে।

বাংলাদেশ নারীদের অবস্থার উন্নতিতে উলে¬খযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে এবং অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার তাদের সুরক্ষা ও কল্যাণের জন্য বিশেষভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

এটি এমন একটি সরকার যা নারীর অধিকার ও সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, যা নিবন্ধে তুলে ধরা আবছা চিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত।

এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল ‘যুব উৎসব ২০২৫’, যেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ২৭ লক্ষ মেয়ে ৩,০০০ খেলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছিল।

বিভিন্ন অঞ্চল, প্রান্তিক সম্প্রদায় এবং আদিবাসী যুবসমাজের ব্যাপক অংশগ্রহণ বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে নারী ও মেয়েদের স্বতঃস্ফূর্ত ও গতিশীল সম্পৃক্ততার প্রতিফলন। 

একটি ফুটবল খেলা বিরোধিতার মুখোমুখি হওয়ার বিষয়টি অন্যান্য ২,৯৯৯টি ইভেন্টের সাফল্যকে মুছে ফেলে না, যা অসংখ্য অংশগ্রহণকারী ও সম্প্রদায় উদযাপন করেছিল।

একটি অনুষ্ঠানে একটি মাত্র বাধার বিষয়ে আলোকপাত করার মাধ্যমে দেশের যুবসমাজের, বিশেষ করে নারীদের প্রাণবন্ত অংশগ্রহন ও দৃঢ় অঙ্গীকারের বিষয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন করে।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ‘চরমপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে যথেষ্ট কঠোরভাবে প্রতিরোধ করেননি’ এই দাবি কেবল মিথ্যাই নয়, বরং এটি নারীর ক্ষমতায়নের প্রতি তার আজীবন প্রতিশ্রুতিকেও উপেক্ষা করে।

প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অধ্যাপক ইউনূস নারীর অধিকারের পক্ষে তার অবস্থানে অটল রয়েছেন। দুই কন্যার পিতা, ইউনূস তার সমগ্র কর্মজীবন এবং গ্রামীণ ব্যাংককে নারীর শক্তিতে তার গভীর বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে গড়ে তুলেছেন, যা শেষ পর্যন্ত তাকে নোবেল পুরষ্কার এনে দিয়েছে।

নারীর অধিকার এগিয়ে নেওয়া এবং তাদের স্বাধীনতা রক্ষায় তার নিষ্ঠা ও কাজ তার খ্যাতির ভিত্তি।

২. ধর্মীয় সহিংসতা সম্পর্কে ভুল ধারণা সংশোধন :

বাংলাদেশের মতো দেশে, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ধর্মীয় সহিংসতার মধ্যে পার্থক্য করা গুরুত্বপূর্ণ। শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পর থেকে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘটিত অনেক সংঘর্ষকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হিসেবে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যদিও বাস্তবে, সেগুলো মূলত রাজনৈতিক প্রকৃতির ছিল।

রাজনৈতিক বিভিন্ন দল অনেক সময় সমর্থন লাভের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে, যা বিষয়টিকে জটিল করে তোলে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার সাথে ধর্মীয় নিপীড়নের মিশ্রণের ঝুঁকি তৈরি করে। পুরো পরিস্থিতিকে একটি সাম্প্রদায়িক সংঘাত হিসাবে উপস্থাপন করা বিভ্রান্তিকর, কারণ এটি প্রকৃত রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক কারণগুলোকে উপেক্ষা করে।

অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার সকল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রক্ষা করার জন্য তার প্রতিশ্রুতি সুস্পষ্ট করেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চলমান কাজ এবং সন্ত্রাসবাদ দমন প্রচেষ্টা এই প্রতিশ্রুতিকে আরও জোরদার করে।

সামাজিক সংস্কার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে চরমপন্থা মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রচেষ্টা ভুল তথ্য ছড়ানোর মাধ্যমে ম্লান হওয়া উচিত নয়।

৩. বৈশ্বিক মঞ্চে বাংলাদেশের ভূমিকা :

বাংলাদেশ নীরবে এশিয়ার অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে একটিতে রূপান্তরিত হচ্ছে, একটি প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় যা বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রচুর সুযোগের প্রতিশ্রুতি দেয়।

সকল প্রতিকূলতার মধ্যেও, বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল হয়েছে যা উল্লেখযোগ্য স্থিতিস্থাপকতার প্রতিফলন। 

গত সাত মাসে, রপ্তানি প্রায় ১২% বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার পরেও ব্যাংকিং খাত গতিশীল রয়েছে এবং স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হার মার্কিন ডলারের বিপরীতে প্রায় ১২৩ টাকায় স্থিতিশীল রয়েছে।

সামনের দিকে তাকালে, বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের নবম বৃহত্তম ভোক্তা বাজারে পরিণত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

৮৪ বছর বয়সী মুহাম্মদ ইউনূস গত আট মাস ধরে যেসব অবিশ্বাস্য কাজ সম্পন্ন করেছেন তার স্বীকৃতি কোথায়? বাংলাদেশের জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য তিনি সারা বিশ্বজুড়ে সফর করে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন।

গত সপ্তাহে চীন সফরের সময় চীন সরকার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশকে ২.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ, বিনিয়োগ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

ঢাকা আগামী সপ্তাহে, বিনিয়োগকারীদের সম্মেলন আয়োজন করবে, যেখানে ৫০টি দেশের ২,৩০০ জনেরও বেশি অংশগ্রহণকারী অংশগ্রহণ করবেন, যার মধ্যে মেটা, উবার ও স্যামসাংয়ের মতো বৈশ্বিক কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারাও থাকবেন।

বিশ্ব ক্রমবর্ধমানভাবে বাংলাদেশকে একটি উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। এটি হচ্ছে আশা, শক্তি ও অভূতপূর্ব সুযোগের গল্প - যা সম্মান ও যথাযথ বিবেচনার দাবি রাখে। 

৪. অতি সরলীকরণ এড়িয়ে চলা এবং একটি জাতিকে অপবাদ দেয়া :

নিউ ইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধে কয়েকটি ঘটনার উলে¬খ রয়েছে, যেমন একজন মহিলার উপর নির্যাতনকারী একজন ব্যক্তিকে মুক্তি দেয়া হয়েছে, যা একটি দেশের চরমপন্থায় পতিত হওয়ার চিত্র তুলে ধরে।

এটি কেবল বিভ্রান্তিকরই নয় বরং ক্ষতিকারক। ১৮ কোটি জনসংখ্যার একটি দেশে, কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা দ্বারা সমগ্র দেশকে সংজ্ঞায়িত করা অযৌক্তিক।

বাংলাদেশ একটি বৈচিত্র্যময় ও গতিশীল সমাজ যেখানে সহনশীলতা, সংস্কৃতি এবং প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে।

ধর্মীয় উগ্রবাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ একা নয়; এটি একটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা যা অনেক দেশ বিভিন্ন রূপে মোকাবেলা করে।

তবে, আইন প্রয়োগ, সামাজিক সংস্কার ও সন্ত্রাসবাদ বিরোধী উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার জন্য ক্রমাগত কাজ করে আসছে।

মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান বা অন্য যে কোনও সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যময় জনসংখ্যাকে রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
 
বিভিন্ন সমাবেশে ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘৃণা ছড়ানোর জন্য সবসময়ই কট্টরপন্থীরা সক্রিয় থাকলেও তাদের ক্ষোভে ঘৃতাহুতি না দেয়া আমাদের দায়িত্ব।

এছাড়া, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে চরমপন্থার উত্থান অনিবার্য এমন চিন্তা অত্যন্ত পূর্বধারণাপ্রসূত।

দেশের গণতান্ত্রিক চেতনা ও প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজ এমন শক্তিশালী যা চরমপন্থী মতাদর্শের উত্থানকে প্রতিহত করে চলেছে।

চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী গতিধারা কেবল চরমপন্থীদের কর্মকাণ্ড দ্বারা নির্ধারিত হবে না।

বাংলাদেশের জনগণ, বিশেষ করে এর যুবসমাজ ও মহিলারা একটি ন্যায়সঙ্গত, গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

পরিশেষে, বাংলাদেশের সহনশীলতার ইতিহাস, গণতন্ত্রের প্রতি তার অঙ্গীকার এবং নারীর ক্ষমতায়নের উপর তার মনোযোগ এই সত্যের প্রমাণ যে, দেশটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও এগিয়ে যাবে।

কয়েকটি নেতিবাচক উদাহরণের উপর মনোযোগ দেওয়ার পরিবর্তে, আমাদের আজকের বাংলাদেশকে সংজ্ঞায়িত করে এমন অগ্রগতি, সহনশীলতা ও দৃঢ় অঙ্গীকারের ব্যাপকতর চিত্রটির স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের