বৃহস্পতিবার,

৩০ জানুয়ারি ২০২৫,

১৭ মাঘ ১৪৩১

বৃহস্পতিবার,

৩০ জানুয়ারি ২০২৫,

১৭ মাঘ ১৪৩১

Radio Today News

বাংলাদেশ সরকার ও মিডিয়া রিফর্ম কমিশনকে উন্মুক্ত চিঠি

রেডিওটুডে রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১৫:০৪, ২৭ জানুয়ারি ২০২৫

আপডেট: ১৫:১২, ২৭ জানুয়ারি ২০২৫

Google News
বাংলাদেশ সরকার ও মিডিয়া রিফর্ম কমিশনকে উন্মুক্ত চিঠি

বাংলাদেশ সরকার ও মিডিয়া রিফর্ম কমিশনের প্রতি উন্মুক্ত চিঠি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাভানাহ স্টেট ইউনিভার্সিটির সাবেক অধ্যাপক ড. সিরাজুল আই. ভূঁইয়া। চিঠিটি হুবুহু তুলে ধরা হলো-

বিষয়: নজরদারির অনুশীলনে স্বচ্ছতা, তত্ত্বাবধান এবং সংস্কারের জরুরি আহ্বান

মাননীয় সরকার ও মিডিয়া রিফর্ম কমিশনের সদস্যবৃন্দ,

সাংবাদিকতার সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত একজন একাডেমিক এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকারের প্রতি গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একজন ব্যক্তি হিসেবে, গভীর দায়বদ্ধতা ও উদ্বেগ নিয়ে আমি আজ আপনাদের উদ্দেশ্যে লিখছি। উন্নত প্রযুক্তি, বিশেষত পেগাসাস স্পাইওয়্যার, যা প্রথমে বৈধ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছিল, বর্তমানে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারগুলোর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি দুর্বল করার হুমকি তৈরি করছে।

প্যাট্রিক হেনরির অমোঘ বাণী, “জনগণের স্বাধীনতা কখনোই নিরাপদ নয়, যদি তাদের শাসকদের কার্যক্রম তাদের থেকে গোপন রাখা হয়”—এখনো প্রাসঙ্গিক এবং গভীর সত্য বহন করে। এটি সরকার পরিচালিত নজরদারির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং গভীর পর্যবেক্ষণের অপরিহার্যতা তুলে ধরে, এমনকি যখন এটি সুরক্ষার নামে আড়াল করা হয়।

এই চিঠির উদ্দেশ্য হলো এমন নজরদারি প্রযুক্তিগুলোর বহুমুখী প্রভাব বিশ্লেষণ করা। এটি জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুরক্ষা রক্ষার জন্য সূক্ষ্ম ভারসাম্য খোঁজার চেষ্টা করে। আমার পেশাগত বুদ্ধিবৃত্তিক জিজ্ঞাসার মাধ্যমে আমি জনসাধারণের বিশ্বাস, অপব্যবহারের সম্ভাবনা এবং গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের ওপর এই প্রযুক্তিগুলোর প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত করতে চাই।

জর্জ অরওয়েল একবার বলেছিলেন, “স্বাধীনতার মানে হলো মানুষকে এমন কথা বলার অধিকার দেওয়া, যা তারা শুনতে চায় না।” এই আলোকে, আমি অনুরোধ করছি যে আমরা আমাদের সরকারের অনুসৃত নজরদারির পদ্ধতি সম্পর্কে সেই অস্বস্তিকর সত্যগুলোকে সাহসের সাথে মোকাবিলা করি। এই আলোচনার এখনই প্রয়োজন, যা বহু আগেই শুরু হওয়া উচিত ছিল, যাতে আমরা এসব শক্তিশালী প্রযুক্তিকে আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে পারি।

এই চিঠি কেবল উদ্বেগ প্রকাশ নয়, বরং একটি আহ্বান। আসুন, আধুনিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলায় আমাদের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য রক্ষার জন্য নজরদারি নীতি ও প্রক্রিয়াগুলো সমালোচনামূলকভাবে মূল্যায়ন করি। যেমন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বলেছিলেন, “যারা সাময়িক নিরাপত্তার জন্য মৌলিক স্বাধীনতা ত্যাগ করতে প্রস্তুত, তারা স্বাধীনতা বা নিরাপত্তার উপযুক্ত নয়।”

আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকার হওয়া উচিত, নিচে উল্লেখিত বিষয়গুলোতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা নিশ্চিত করা, যাতে আমাদের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে টিকে থাকে।

বাংলাদেশে পেগাসাস স্পাইওয়ারের বর্তমান ব্যবহার

আমি অনুরোধ জানাই, বাংলাদেশে পেগাসাস স্পাইওয়্যার এবং সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিগুলোর বর্তমান ব্যবহারের বিষয়ে আপডেট দেওয়ার জন্য। সরকার কি নিশ্চিত করতে বা অস্বীকার করতে পারে যে এটি এখনো দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে? যদি এই সরঞ্জামগুলো সত্যিই ব্যবহৃত হয়, তবে কোন আইনি কাঠামো এবং তত্ত্বাবধানে এগুলো পরিচালিত হচ্ছে? জনসাধারণের আস্থা বজায় রাখা এবং আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা সংবিধান অনুযায়ী গোপনীয়তার অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য এই তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিচারপতি লুইস ব্র্যান্ডাইস বলেছিলেন, “সূর্যের আলো সর্বোত্তম জীবাণুনাশক, আর বৈদ্যুতিক আলো সর্বোত্তম পুলিশ।” এই নীতির আলোকে, আমি অনুরোধ করছি নজরদারি কার্যক্রমে সমান মাত্রার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে। আমি মনে করি, নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলোর কোনো দেরি সহ্য হয় না:

১. অপব্যবহার প্রতিরোধের ব্যবস্থা: নজরদারি প্রযুক্তিগুলোর অপব্যবহার প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? সাংবাদিক, কর্মী এবং জনসাধারণের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও অধিকার সুরক্ষার জন্য কি কোনো শক্তিশালী ব্যবস্থা রয়েছে?

২. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা: এই ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার কীভাবে স্বচ্ছ করা হবে? এটি পর্যালোচনার জন্য কি স্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সংস্থা রয়েছে, এবং তারা কি তাদের ফলাফল প্রকাশ করে?

৩. সাংবাদিক ও কর্মীদের সুরক্ষা: সাংবাদিক এবং কর্মীদের বিরুদ্ধে অ-authorised নজরদারি প্রতিরোধে সরকার কী ব্যবস্থা নেবে, যাতে তারা ভীতিহীনভাবে রিপোর্ট করতে এবং কাজ করতে পারে?

৪. আইনি কাঠামো ও সংস্কার: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? এই আইন কি প্রয়োজনীয়, সুষম এবং বৈধ?

৫. অতীতের অপব্যবহার: অতীতের সরকারগুলো নজরদারি সরঞ্জামের অপব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগগুলো তদন্ত করা হয়েছে কি? ভবিষ্যতে অপব্যবহার রোধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?

৬. সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের সঙ্গে পরামর্শ:  কোনো ফোরাম বা আলোচনা সভা রয়েছে যেখানে সরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিক এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা উন্মুক্ত আলোচনা করতে পারেন?

৭. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও মানদণ্ড: ডিজিটাল নজরদারি এবং সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা কীভাবে রয়েছে?

শেষে, জর্জ অরওয়েলের সতর্কবাণী, “বাস্তব সত্যের ধারণা পৃথিবী থেকে মুছে যাচ্ছে। মিথ্যা ইতিহাসে পরিণত হবে”—আমাদের জন্য একটি অমোঘ স্মরণ। আমি অনুরোধ করছি যে এই প্রশ্নগুলো যথাযথ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হোক, কারণ আজকের সিদ্ধান্ত আমাদের ভবিষ্যতের উপর চিরস্থায়ী প্রভাব ফেলবে। এটি নির্ধারণ করবে যে গোপনীয়তা, স্বাধীনতা এবং আইনের শাসন ও মানবাধিকারের প্রতি আমাদের জাতীয় অঙ্গীকার প্রজন্ম ধরে টিকে থাকবে কিনা।

আমি আশা করি, এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো যথাযথ মনোযোগ পাবে এবং বাংলাদেশের নাগরিকদের মানবাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পথ প্রসারিত করবে। আজকের নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো আমাদের জাতির রাজনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক ভবিষ্যৎকে ন্যায়বিচার, সমতা ও মর্যাদার ভিত্তিতে গড়ে তুলবে।

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের