রোববার,

০৫ জানুয়ারি ২০২৫,

২২ পৌষ ১৪৩১

রোববার,

০৫ জানুয়ারি ২০২৫,

২২ পৌষ ১৪৩১

Radio Today News

প্রধান বিচারপতি ও বিচারক নিয়োগে পরিবর্তনের প্রস্তাব

রেডিওটুডে রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৯:৩৪, ৩ জানুয়ারি ২০২৫

Google News
প্রধান বিচারপতি ও বিচারক নিয়োগে পরিবর্তনের প্রস্তাব

প্রধান বিচারপতিসহ বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তনের প্রস্তাব করছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। স্বচ্ছতার পাশাপাশি বিচার কার্যক্রমকে আরও গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে ১১টি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য সরকারের প্রভাবমুক্ত স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা।

বিভিন্ন মাধ্যম থেকে পাওয়া প্রায় ১৫ হাজার ব্যক্তির মতামত ও লিখিত প্রস্তাবের ভিত্তিতে এ বিষয়গুলো নির্ধারণ করা হয়েছে। তাদের মতামতের আলোকে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরির কার্যক্রম চলছে। গতকাল বৃহস্পতিবার এই প্রতিবেদন তৈরির কাজ শেষ করার কথা ছিল। তবে এই কার্যক্রম শেষ না হওয়ায় কমিশনের মেয়াদ আরও দুই সপ্তাহ বাড়ানো হয়েছে। তবে এর অফিস আদেশ এখনও প্রকাশ হয়নি। আগামী ১৫ বা ১৬ জানুয়ারি কমিশনের প্রতিবেদন চূড়ান্ত হতে পারে।

কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, প্রধান বিচারপতি নিয়োগে রাষ্ট্রপতির স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের বিলোপ চাইবে বিচার সংস্কার কমিশন। কমিশন মনে করে, ‘সংবিধানে এই মর্মে বিধান থাকা প্রয়োজন যে, রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম বিচারককে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করবেন।’ এ ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের বিচারপতির সংখ্যা হবে ৭ জন এবং প্রধান বিচারপতির চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনে অধিকসংখ্যক বিচারপতি নিয়োগ করা হবে। একইভাবে প্রধান বিচারপতি ব্যতীত অন্যান্য বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ৯ সদস্যের ‘সুপ্রিম কোর্ট জাজেস অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশন’ গঠন এবং ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহরে হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ স্থাপন, বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতেও কমিশনের প্রতিবেদনে নানা প্রস্তাব থাকছে।

গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর রাষ্ট্র কাঠামোতে ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে বিচার বিভাগসহ ১০টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। এর মধ্যে গত ৩ অক্টোবর আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানের নেতৃত্বে আট সদস্যের বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার। ৯০ দিনের মধ্যে এ কমিশনকে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল।

কমিশন সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবেদন তৈরির লক্ষ্যে কর্মরত বিচারক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে পাওয়া ব্যক্তিদের মতামত পর্যালোচনার পর বিষয়ভিত্তিক মতামত চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ১১টি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

এর মধ্যে রয়েছে উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে আইন প্রণয়ন, অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরিবিধি-শৃঙ্খলা নির্ধারণের মাধ্যমে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা, সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় স্থাপন, 

বিনামূল্যের আইনি সহায়তা কার্যক্রমকে (লিগ্যাল এইড) যুগোপযোগী ও গতিশীল করা, আদালতের আইন কর্মকর্তা নিয়োগে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা, স্বাধীন তদন্ত সংস্থা গঠন, আদালতের বাইরে মামলা নিষ্পত্তি-সংক্রান্ত বিকল্প বিরোধ (এডিআর) নিষ্পত্তি ব্যবস্থাকে গতিশীল ও কার্যকর করা, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আদালতগুলোকে ডিজিটাইজেশনের আওতায় উন্নতকরণ, বিচারক ও আইনজীবীদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, আদালতের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন এবং আদালত ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মাধ্যমে মামলাজট নিরসন করা। এসব বিষয়ে জনসাধারণের মতামত এবং বিদ্যমান আইন ও বিধি বিচার সংস্কার কমিশন বর্তমানে পর্যালোচনার পাশাপাশি প্রতিবেদনে উল্লেখ করার লক্ষ্যে কাজ করছে। উল্লিখিত ১১টি বিষয়ের বাইরে আরও অন্তত ১৪টি বিষয় রয়েছে। সেগুলো সমন্বয় করে সারসংক্ষপ আকারে কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্কার কমিশনের সদস্য সাবেক জেলা ও দায়রা জজ এবং সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আমরা কয়েক শ সুপারিশ পেয়েছি। তবে সেগুলো প্রায় সব একই ধরনের। এ জন্য কতগুলো বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে। এই বিষয়গুলোর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ জনসাধারণের মতামতগুলো প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হবে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কমিশনও সুপারিশ করবে। আগামী ১৫ বা ১৬ জানুয়ারি প্রতিবেদন তৈরির কাজ শেষ করার লক্ষ্যে কমিশন কাজ করছে। তিনি জানান, কমিশনের মেয়াদ ৯০ দিনের মধ্যে, অর্থাৎ ২ জানুয়ারির মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও প্রতিবেদন তৈরির কাজ শেষ হয়নি। এ জন্য সরকার থেকে কমিশনের মেয়াদ আরও দুই সপ্তাহ বাড়ানো হয়েছে। তবে এখনও অফিস আদেশ কমিশনের কাছে পৌঁছেনি।

জানা গেছে, কমিশন গঠনের পর সংশ্লিষ্টরা সরেজমিন দেশের বিভিন্ন আদালত পরিদর্শনের পাশাপাশি জেলা ও উপজেলায় পৃথক মতবিনিময় সভা করেছে। নির্ধারিত ওয়েবসাইটের মাধ্যমে গত ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত জনসাধারণের মতামত নেওয়া হয়। সাধারণ নাগরিক, আইনজীবী, বিচারক এবং আদালত সম্পর্কিত সহায়ক কর্মচারীসহ মোট ১২ হাজার ৭২১ জন মতামত দেন। এ ছাড়া প্রায় আড়াই হাজার ব্যক্তির লিখিত মতামত ই-মেইল এবং চিঠির মাধ্যমে কমিশনে জমা হয়েছে। এসব মতামত ও সুপারিশ থেকে চিহ্নিত অংশ কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে সন্নিবেশ করার কাজ চলছে।

চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরির আগে কমিশনের পক্ষ থেকে ১৪ পৃষ্ঠার একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এর অনুলিপি গত মাসে সরকারের সংশ্লিষ্ট কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাদের কাছে পাঠানো হয়। প্রতিবেদনে প্রধান বিচারপতি নিয়োগে রাষ্ট্রপতির স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা বিলোপের পাশাপাশি বিচারক নিয়োগে পৃথক কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রধান বিচারপতি ছাড়া অন্যান্য বিচারপতি নিয়োগের জন্য পৃথক কমিশন গঠনের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিচারক নিয়োগের বিষয়ে বিদ্যমান সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদে এককভাবে প্রধান বিচারপতির সুপারিশ এবং নির্বাহী কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিধান আছে। এই পদ্ধতির পরিবর্তে যথাসম্ভব স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় মেধা, সততা ও দক্ষতার মূল্যায়নকারী একটি কমিশনের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য নিয়োগ-পদ্ধতি প্রবর্তন করা বাঞ্ছনীয়। এ লক্ষ্যে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ৯ সদস্যবিশিষ্ট ‘সুপ্রিম কোর্ট জাজেস অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশন’ (সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ কমিশন) নামে একটি কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। কমিশনের অন্য আট সদস্য হবেন আপিল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম দু’জন বিচারক, হাইকোর্ট বিভাগের কর্মে প্রবীণতম দু’জন বিচারক, সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, অ্যাটর্নি জেনারেল, সুপ্রিম কোর্ট বার সমিতির সভাপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের অন্য একজন আইনজীবী। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে এই নিয়োগ কমিশনের মতামত প্রাধান্য পাবে।

বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যমান সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক্‌করণ এবং অনুচ্ছেদ ১১৬তে বিচার-কর্মবিভাগে কর্মরত বিচারকদের স্বাধীনতার ঘোষণা আছে। কিন্তু বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে বিচারিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিঘ্ন সৃষ্টি করা হয়। অধস্তন আদালতের বিচারক কর্তৃক নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও কার্যকরভাবে বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান বাধা হচ্ছে বিদ্যমান সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৬তে বিধৃত দ্বৈত প্রশাসনিক ব্যবস্থা। এ অবস্থায় মাসদার হোসেন মামলায় আপিল বিভাগ ১২ দফা নির্দেশনা দিলেও তা নানাভাবে অবহেলিত হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে কমিশনের প্রতিবেদনে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় গঠন, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা গঠনসহ নানা প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনের আলোকে প্রস্তুত করা হচ্ছে।

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ সমকালকে বলেন, কমিশন প্রস্তাব কার্যকর করতে কিছু ক্ষেত্রে বিদ্যমান সংবিধান ও আইনের সংস্কার করতে হবে। এ জন্য সংসদ লাগবে। নির্বাচিত সরকার চাইলে কেবল সংবিধান ও আইন সংশোধনের বিষয়টি কার্যকর হবে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমেও কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়ন করত পারে। কিন্তু এই অধ্যাদেশগুলো পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে সংসদে পাস করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিসসহ বেশ কিছু বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি করেছিল। কিন্তু সেগুলো পরবর্তী সরকার অনুমোদন করেনি, অর্থাৎ সংসদে উত্থাপন হয়নি। এ জন্য বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন।

রেডিওটুডে নিউজ/আনাম

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের