
রমজানে রোজা রাখার সময় অনেকেই ভুলে যাওয়া বা অসাবধানতার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। কেউ কাজের প্রতি মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন মনে করেন। কেউ আবার প্রায়শই জিনিসপত্র হারিয়ে ফেলেন। এ ছাড়া কাজ শেষ করতে বেশি সময় নেন অনেকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘রমজান ব্রেন’ নামে পরিচিত এই সমস্যা বেশ সাধারণ এবং এটি বিভিন্ন কারণে ঘটে থাকে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের সেজ ক্লিনিকের মনোবিজ্ঞানী সারাহ মামারি বলেছেন, রমজানের সময় মানুষের সাধারণ কিছু মানসিক সমস্যার মধ্যে রয়েছে ভুলে যাওয়া, মনোযোগের অভাব, মানসিক ক্লান্তি, ধীর গতি এবং মেজাজ পরিবর্তনের প্রবণতা।
এই বিশেষজ্ঞ জানান, শক্তির জন্য মস্তিষ্ক প্রধানত গ্লুকোজের উপর নির্ভরশীল। আর রমজানের সময় রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে গেলে মনোযোগ, স্মৃতি ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা প্রভাবিত হতে পারে। এটিকে মস্তিষ্কের কুয়াশাচ্ছন্ন অবস্থা বলেও বর্ণনা করেছেন কেউ কেউ।
দুবাইভিত্তিক বায়োহ্যাকিং ও দীর্ঘায়ু বিশেষজ্ঞ এবং লিমিটলেস হিউম্যান এবং রিস্টোর ফিটনেসের প্রতিষ্ঠাতা ড. এলি আবিরাচেদের মতে, এই সময় এমন একটি অনুভূতি হয় যার কারণে মনোযোগ দিতে সমস্যা হয়, মনে হয় যেন মস্তিষ্কে কুয়াশাচ্ছন্ন ভাব রয়েছে। রোজা রেখে সাধারণ কাজ করতেও বেশি সময় লাগে। বিশেষত বিকেলের দিকে শক্তি স্তর কমে গেলে অনেকের কর্মদক্ষতা, মেজাজ ও শক্তির ওপর প্রভাব ফেলে।
রমজান ব্রেনের একাধিক কারণ
মেডকেয়ার কামালি ক্লিনিকের কাউন্সেলর ও কগনিটিভ আচরণ থেরাপিস্ট ক্যারোলিন ইয়াফে বলেছেন, ‘রমজান ব্রেন’ ঘটার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে খাদ্যাভ্যাস প্রধান ভূমিকা পালন করে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা রাখার ফলে শরীরে তরলের ঘাটতি হতে পারে। বিশেষ করে ইফতার ও সেহরির মধ্যে যথেষ্ট পানি পান না করলে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে ক্লান্তি। বাড়তে পারে বিভ্রান্তি এবং কমে যেতে পারে মনোযোগ ।
সারাহ ব্যাখ্যা করেন, মস্তিষ্ক গ্লুকোজের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। রোজার কারণে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যায়। এমন হলে দীর্ঘ সময়ের জন্য মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। যেমন—দীর্ঘ মিটিং, শিক্ষকতা বা পড়াশোনার ক্ষেত্রে মনোযোগ থাকে না। রোজা রাখতে থাকলে প্রতিনিয়ত গ্লুকোজের মজুদ কমতে থাকে। ফলে দিনদিন মানসিক স্বচ্ছতা হ্রাস পায় এবং ‘ব্রেন ফগ’ দেখা দিতে পারে।
ঘুমের ঘাটতি, ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্যের অভাব এবং ক্যাফেইন থেকে বিরত থাকার বিষয়গুলোও এর পেছনে কাজ করে। সেহরির জন্য ওঠা এবং রাতের নামাজের পর দেরি করে ঘুমাতে যাওয়ার ফলে গভীর ঘুম ও দ্রুত চোখের নড়াচড়াজনিত (আরইএম) ঘুম কম হয়। এমন হলে মস্তিষ্কের পুনরুদ্ধার ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। এ ছাড়াও যথাযথ পরিমাণে লবণ, ম্যাগনেসিয়াম ও পটাসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার না খেলে মস্তিষ্ক ও শরীর শক্তি ও মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না, যোগ করেন ড. এলি।
‘রমজান ব্রেন’ কাটানোর উপায়
সারাহ’র মতে, ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী নিয়মিত রোজা রাখলেও কিছু সহজ কৌশল অনুসরণে ‘রমজান ব্রেন’ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এ জন্য সুষম সেহরি বা জটিল কার্বোহাইড্রেট, স্বাস্থ্যকর চর্বি ও প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার সেহরির সময় খাওয়া উত্তম। এই খাবার সারাদিন শক্তি সরবরাহ করতে পারে। অফিসের কাজ, পড়াশোনা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো কাজে বেশি মানসিক মনোযোগ প্রয়োজন। এই কাজগুলো দিনের প্রথম ভাগে করা উচিত। মস্তিষ্ক এ সময় সবচেয়ে বেশি সচেতন থাকে। অন্যদিকে, অপেক্ষাকৃত হালকা ও রুটিন কাজগুলো বিকেলের দিকে রাখা যেতে পারে।
সারাহ বলেন, ব্রেন ফগকে মেনে নেওয়ার মানসিকতা অর্জন করাও গুরুত্বপূর্ণ। রমজান আমাদের মানসিক, আবেগ ও আধ্যাত্মিক কল্যাণকে পুনর্বিন্যাস করার এক অনন্য সুযোগ দেয়। ব্রেন ফগকে একটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখার পরিবর্তে ধীরগতিতে চলার, বর্তমান মুহূর্তে থাকার এবং আত্ম-সহানুভূতি চর্চার সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
আমাদের শরীরকে পুষ্টি দিয়ে, রুটিনকে অপ্টিমাইজ করে এবং রমজানের সামাজিক ও আধ্যাত্মিক দিকগুলোকে গ্রহণ করে এই মাসটিকে আমরা আরও উদ্দীপনার সঙ্গে পার করতে পারি বলেও জানান তিনি।
ক্যারোলিন বলেন, ইফতার থেকে সেহরির মধ্যে পর্যাপ্ত পানি পান করা এবং শরীরকে হাইড্রেট রাখা অত্যন্ত জরুরি। এর মাধ্যমে মানসিক দক্ষতা বজায় রাখার পাশাপাশি সারাদিন সজাগ থাকা যায়।
সমস্যাটি নিরসনে ড. এলি জানিয়েছেন, এ ক্ষেত্রে ঘুমের মানোন্নয়ন ও হালকা ব্যায়াম খুবই কার্যকর হতে পারে। রোজা রাখার কারণে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে নিজে থেকেই এর গুণগত মান বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। ঘুমানোর আগে ম্যাগনেসিয়াম জাতীয় খাবার খেতে হবে এবং নীল আলো এড়িয়ে চলতে হবে। ইফতার ও সেহরির মাঝে যতটা সম্ভব গভীর, প্রশান্তিময় ঘুম নিশ্চিত করতে হবে।
এ ছাড়া শরীরকে ক্লান্ত না করে রক্ত সঞ্চালন বাড়ানো ও মানসিক চাপ কমানোর জন্য ইফতারের আগে হালকা হাঁটা, যোগব্যায়াম বা শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।