বৃহস্পতিবার,

২৬ ডিসেম্বর ২০২৪,

১২ পৌষ ১৪৩১

বৃহস্পতিবার,

২৬ ডিসেম্বর ২০২৪,

১২ পৌষ ১৪৩১

Radio Today News

রিউমর স্ক্যানারের প্রতিবেদন

বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় ৪৯ গণমাধ্যমে গুজবের ছড়াছড়ি

রেডিওটুডে রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২০:৫৮, ৬ ডিসেম্বর ২০২৪

Google News
বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় ৪৯ গণমাধ্যমে গুজবের ছড়াছড়ি

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে একের পর এক গুজব ছড়ানো হচ্ছে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা সীমা ছাড়িয়ে ভারতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। গণমাধ্যমগুলো পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের বিষয় নিয়ে ছড়াচ্ছে একের পর এক গুজব।

রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ১২ আগস্ট থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতীয় ৪৯টি গণমাধ্যমে অন্তত ১৩টি ভুয়া খবর প্রচার করা হয়েছে।

এর মধ্যে, রিপাবলিক বাংলা সর্বাধিক ৫টি গুজব প্রচার করেছে। দ্বিতীয় অবস্থানে হিন্দুস্তান টাইমস, জি নিউজ ও লাইভ মিন্ট অন্তত ৩টি করে গুজব প্রকাশ করেছে। এছাড়া, রিপাবলিক, ইন্ডিয়া টুডে, এবিপি আনন্দ এবং আজতক অন্তত ২টি করে গুজব প্রচার করেছে। বাকি ৪১টি গণমাধ্যম অন্তত একটি করে গুজব প্রচার করেছে।

এসব গুজবের মধ্যে ছিল—শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর তার নামে ভুয়া খোলা চিঠি, মুসলিম ব্যক্তির নিখোঁজ পুত্রের সন্ধানে মানববন্ধন করার ভিডিওকে হিন্দু ব্যক্তির দাবিতে প্রচার, ড. মুহাম্মদ ইউনূস আইসিইউতে ভর্তি হওয়ার ভুয়া খবর, বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ভিত্তিহীন দাবি, ট্রাম্পের বিজয়ের পর ড. ইউনূস ফ্রান্সে পালিয়ে যাওয়ার ভুয়া দাবি, পাকিস্তানি জাহাজের মাধ্যমে অস্ত্র আনার মিথ্যা দাবি, নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবী হিসেবে প্রচার, বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেল বন্ধ হওয়া গুজব, বাংলাদেশে মুসলিমদের হামলায় হিন্দু মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুরের দাবিতে ভারতের প্রতিমা বিসর্জনের ভিডিও প্রচার, শ্যামলী পরিবহনের বাসে হামলার মিথ্যা তথ্য চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবীর ওপর হামলার ভুয়া দাবি এবং বাংলাদেশে জঙ্গি হামলা হতে পারে জানিয়ে যুক্তরাজ্য ভ্রমণ সতর্কতা জারির বিভ্রান্তিকর খবর।

৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর শেখ হাসিনার নামে একটি খোলা চিঠি ঘিরে ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় গণমাধ্যমে দাবি করা হয়, দিল্লিতে আশ্রয় নেওয়ার পর শেখ হাসিনা ওই চিঠিতে তার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছেন। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা গেছে, শেখ হাসিনা এমন কোনো চিঠি দেননি।

ভুয়া চিঠিটি প্রথমে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। পরে এটি ভারতের আগরতলাভিত্তিক দৈনিক ত্রিপুরা ভবিষ্যত পত্রিকার প্রিন্ট সংস্করণে প্রকাশিত হয়। পত্রিকায় তারিখসহ প্রকাশিত এই ভুয়া চিঠির স্ক্রিনশট দ্রুত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর এটি ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশের কয়েকটি গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয়।

৫ আগস্টের পর ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে দাবি করা হয়, একজন হিন্দু ব্যক্তি তার নিখোঁজ পুত্রের সন্ধান দাবিতে মানববন্ধন করছেন। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই ব্যক্তি আসলে মুসলিম এবং তার নাম বাবুল হাওলাদার। ২০১৩ সালে নিখোঁজ হওয়া ছেলের সন্ধানে মানববন্ধন করেছিলেন তিনি।

৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ভারতীয় গণমাধ্যমে একটি ভুয়া খবর ছড়িয়ে পড়ে। এতে দাবি করা হয়, ড. ইউনূস অসুস্থ হয়ে আইসিইউতে ভর্তি রয়েছেন। খবরের সঙ্গে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ব্যক্তির ছবিও প্রকাশিত হয়। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ছবিটি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নয় এবং এটি সাম্প্রতিক বা বাংলাদেশের কোনো ঘটনার সঙ্গেও সম্পর্কিত নয়। প্রকৃতপক্ষে, ড. ইউনূস সুস্থ আছেন এবং স্বাভাবিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করছেন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ভারতীয় গণমাধ্যমে দাবি করা হয়, বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে এ দাবির কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য বা প্রমাণ ছাড়াই এমন ভুয়া খবর প্রচারিত হয়।

এছাড়া, ৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের পর ভারতীয় গণমাধ্যমে আরেকটি ভিত্তিহীন দাবি ছড়ায়। এতে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফ্রান্সে পালিয়ে গেছেন। কিন্তু রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, এ দাবিও মিথ্যা। প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা উড়োজাহাজের ছবিটি আসলে ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের ফ্রান্স থেকে বাংলাদেশে ফেরার সময়ের।

স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো গত ১৩ নভেম্বর পাকিস্তানের করাচি থেকে একটি কনটেইনারবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে। এ ঘটনাকে ঘিরে ভারতীয় গণমাধ্যমে দাবি করা হয়, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সামরিক জাহাজ ‘সোয়াত’, যা অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে চট্টগ্রামে এসেছিল, সেই জাহাজ আবারও বন্দরে এসেছে। এমনকি ওই জাহাজে পাকিস্তান থেকে অস্ত্র আনার অভিযোগও তোলা হয়।

তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে এসব দাবি ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছে। নোঙর করা জাহাজটির নাম ‘এমভি ইউয়ান জিয়ান ফা ঝং’, এটি একটি বাণিজ্যিক জাহাজ। জাহাজটি অস্ত্র নয়, বরং শিল্পের কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য বহন করেছিল।

২৫ নভেম্বর ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরদিন, ২৬ নভেম্বর, তাকে চট্টগ্রাম আদালতে হাজির করা হলে জামিন নামঞ্জুর করা হয়। আদালত প্রাঙ্গণে উত্তেজনার মধ্যে চিন্ময়কে প্রিজন ভ্যানে তুলে কারাগারে পাঠানোর সময় তার অনুসারীরা বিক্ষোভ শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ও বিজিবি লাঠিপেটা এবং সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে। সংঘর্ষের একপর্যায়ে চট্টগ্রাম জেলা আদালতের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ নিহত হন।

এ ঘটনার পর ভারতীয় গণমাধ্যমে দাবি করা হয়, চিন্ময়ের আইনজীবী ছিলেন সাইফুল ইসলাম এবং তাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই এই সহিংসতা ঘটানো হয়। তবে এই দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। চিন্ময়ের আইনজীবী শুভাশীষ শর্মা, সাইফুল ইসলাম নন।

এরপর ভারতীয় কিছু গণমাধ্যমে দাবি করা হয়, বাংলাদেশে ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার বন্ধ করা হয়েছে। রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে চ্যানেলগুলো এখনও সচল থাকতে দেখা যায়। একই সঙ্গে, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং ক্যাবল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বিষয়টি গুজব বলে রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করে।

ভারতীয় কতিপয় গণমাধ্যমে দাবি করা হয়, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী চীনের প্রযুক্তিগত সহায়তায় চিকেন নেকের কাছে এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমানঘাঁটি নির্মাণ করবে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই দাবি পুরোপুরি মিথ্যা। লালমনিরহাটের বিমানবন্দর দীর্ঘ ছয় দশক ধরে বন্ধ রয়েছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে এর কার্যক্রম পুনরায় চালুর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

সম্প্রতি, বাংলাদেশে মুসলিমদের দ্বারা হিন্দু মন্দিরে হামলা করে প্রতিমা ভাঙচুরের অভিযোগে একটি ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। এই দাবি ভারতের কিছু গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয়। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, ভিডিওটি বাংলাদেশে নয়, বরং ভারতের পূর্ব বর্ধমান জেলার খণ্ডঘোষ সুলতানপুর গ্রামে প্রতিমা বিসর্জনের দৃশ্য। ভিডিওটি বাংলাদেশের হিন্দু মন্দিরে হামলার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঢাকা-আগরতলা-ঢাকা রুটে শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে বাংলাদেশি ট্রাকের সংঘর্ষের একটি সংবাদ ভারতের কিছু গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। আরও দাবি করা হয়, শ্যামলী পরিবহনের বাসে থাকা ভারতীয় যাত্রীদের স্থানীয়রা প্রাণনাশের হুমকি দেয় এবং ভারতবিরোধী স্লোগান দেয়। কিন্তু রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই দাবিগুলোর কোনো সত্যতা নেই। ইচ্ছাকৃতভাবে নয়, দুর্ঘটনাটি মূলত ওভারটেকিংয়ের কারণে ঘটেছিল।

চিন্ময় দাসের গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে হাসপাতালের চিকিৎসাধীন একজনের ছবি নিয়ে বিভিন্ন গুজব ছড়ানো হয়। দাবি করা হয়, ওই ব্যক্তি রমেন রায়, যিনি চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী। আরো বলা হয়, মুসলিমরা তার বাড়ি ভাঙচুর করে এবং হামলা চালিয়ে তাকে আইসিইউতে ভর্তি করেছে। রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা গেছে, রমেন রায় চিন্ময় দাসের আইনজীবী নন এবং তার মামলার সঙ্গেও কোনো সম্পর্ক নেই। প্রকৃতপক্ষে, ২৫ নভেম্বর শাহবাগে চিন্ময় দাসের গ্রেপ্তার বিরোধী সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কর্মসূচিতে দুর্বৃত্তদের হামলায় রমেন রায় আহত হন। তবে তার বাড়ি ভাঙচুরের খবর বা কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

সম্প্রতি ভারতীয় কিছু গণমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে, যুক্তরাজ্য বাংলাদেশে যেকোনো সময় জঙ্গি হামলা হতে পারে জানিয়ে ভ্রমণ সতর্কতা জারি করেছে। তবে এই দাবি বিভ্রান্তিকর এবং বাস্তবতার সঙ্গে পুরোপুরি মিল নেই।

যুক্তরাজ্যের ভ্রমণ সতর্কতা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং ভারত, ইন্দোনেশিয়া, জার্মানি, স্পেন, শ্রীলঙ্কা, ফ্রান্সসহ বিশ্বের অনেক দেশের ক্ষেত্রেই দীর্ঘদিন ধরে কার্যকর রয়েছে। এককভাবে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে এমন প্রচারণা তথ্য বিকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। বিশেষভাবে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক সহিংসতার প্রেক্ষিতে সেখানে ভ্রমণ সতর্কতা জারি করা হলেও বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে এমন কোনো বিশেষ সতর্কতা আরোপ করা হয়নি। পাশাপাশি, যুক্তরাজ্যের ভ্রমণ নির্দেশিকা অনুযায়ী, জঙ্গি হামলার সম্ভাবনার দিক থেকে বাংলাদেশ নয়, বরং ভারত, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তানের মতো দেশগুলোকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের