ভারতে নতুন আতঙ্কের নাম 'গিয়ান-ব্যারে সিন্ড্রোম'। সংক্রামকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে শরীর অবশ করা রোগটি। কেবল মহারাষ্ট্রে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬৩ জনে। এদের মধ্যে ছয় বছরের এক শিশুসহ ২৮ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক, আছেন ভেন্টিলেটর সাপোর্টে। প্রাণ গেছে অন্তত তিনজনের।
গিয়ান-ব্যারে সিন্ড্রোম, সংক্ষেপে জিবিএস। স্নায়বিক এ রোগে আক্রান্ত হলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সরাসরি আক্রমণ করে বসে পেরিফেরাল নার্ভাস সিস্টেম, অর্থাৎ মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ড বাদে বাকি পুরো শরীরের স্নায়ুতন্ত্রকে। বিরল এ রোগে প্রতি বছর লাখে বড়জোর এক-দুজন আক্রান্ত হলেও ভারতে গেল এক মাসে জিবিএস শনাক্ত হয়েছেন দেড়শ'র বেশি মানুষ।
গিয়ান-ব্যারেতে আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষই চিকিৎসা নিয়ে পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু ভারতে হঠাৎ আশঙ্কাজনকভাবে ছড়িয়ে পড়া রোগটিতে আক্রান্ত অনেকেরই পেশি দুর্বল হয়ে দেহ অবশ হতে শুরু করেছে। জানুয়ারির শুরু থেকে সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত মহারাষ্ট্রে জিবিএসে আক্রান্ত সন্দেহে চিকিৎসা নিয়েছেন দেড় শতাধিক, যাদের মধ্যে ১২৭ জনের দেহে রোগটি শনাক্ত হয়েছে। একদিন আগেও সন্দেহভাজন আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৫৮।
ভারতের চিকিৎসক ও স্নায়ু বিশেষজ্ঞ ড. কুনাল বাহরানি বলেন, ‘জিবিএস হলো এক ধরনের অটোইমিউন অবস্থা যেখানে আমাদের নিজেদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আমাদের কোষকেই আক্রমণ করে বসে, বিশেষ করে স্নায়ুতন্ত্রকে। সাধারণত কোনো ধরনের ভাইরাল বা ব্যাক্টেরিয়াল ইনফেকশনের পর রোগটি দেখা দেয়।’
আক্রান্তদের মধ্যে ছয় বছরের শিশুসহ বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক, আছেন কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস বা ভেন্টিলেটর সাপোর্টে। একইসঙ্গে, ঘটেছে প্রাণহানিও। চিকিৎসকরা বলছেন, শ্বাসনালি পর্যন্ত পৌঁছালে জিবি সিন্ড্রোম গুরুতর হয়ে দাঁড়ায়। হাত, পায়ের তালুতে অবশ অনুভূতি রোগটির প্রাথমিক লক্ষণ। ধীরে ধীরে বিভিন্ন পেশি দুর্বল এবং অস্থিসন্ধি নাড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। বাহু ও পা থেকে উপসর্গ দেখা দেয়া শুরু হয়, পরের দু' থেকে চার সপ্তাহে অসুস্থতা বাড়তে শুরু করে।
ড. কুনাল বাহরানি বলেন, ‘জিবি সিন্ড্রোমে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে উপসর্গগুলো গুরুতর রূপ নেয় এবং শ্বাসনালিতে পৌঁছে যায়। এই রোগীদের ক্ষেত্রে এই কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের প্রয়োজন হয়।’
রাজ্যে শুধু পুনে শহরে রোগটি সীমিত থাকায় হঠাৎ এ সংক্রমণের কারণ খতিয়ে দেখতে বিশেষজ্ঞ দল গঠন করেছে রাজ্য সরকার। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, একটি কুয়ার পানি থেকে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ রূপ নিচ্ছে জিবিএসে। খাবারের মাধ্যমে ছড়ানো ব্যাকটেরিয়াটি সারা বিশ্বে জিবিএসের জন্য দায়ী বলে বিবেচনা করা হয়।
ভারতের মহারাষ্ট্রের রাজ্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রকাশ আবিতকর বলেন, ‘পুনে শহরে জিবিএস ছড়িয়ে পড়ছে। দিন দিন এটা রোগটি বেড়েই চলেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। সেজন্য আমরা এখানে এসেছি। এই এলাকায় যে কুয়া আছে, সেখানকার পানির নমুনা বিশ্লেষণ চলছে। এ বিষয়ে এখন আমরা বিশেষজ্ঞদের মত নেবো।’
ভারতে জিবিএস নতুন নয়। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে দেড়শ' জিবিএস রোগীকে পর্যবেক্ষণ করেছে ব্যাঙ্গালোরভিত্তিক মেন্টাল হেল্থ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সেস, যাদের মধ্যে ৭৯ শতাংশের মধ্যে জিবিএসের উপসর্গ দেখা দেয়ার আগে তারা কোনো না কোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। এদের এক-তৃতীয়াংশের দেহে শনাক্ত হয় ক্যাম্পিলোব্যাকটার জিৎজুনি নামে বিশেষ এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া।
নব্বইয়ের দশকে জিবিএসের সঙ্গে ক্যাম্পিলোব্যাকটার জিৎজুনি ব্যাকটেরিয়ার যোগসূত্র প্রথম আবিষ্কৃত হয় চীনে। দেশটিতে হাঁস-মুরগির মধ্যে জীবাণুটি মেলে। বর্ষায় হাঁস-মুরগি থেকে জীবাণুটি পানিতে ছড়ায় এবং সেই পানিতে খেলাধুলা করা শিশুদের মধ্যে প্রতি মৌসুমেই জিবিএসের প্রকোপ দেখা যায়। তবে, তুলনামূলক পরিচ্ছন্ন দেশগুলোতে জিবিএসের প্রকোপ কম।