ইরানের ২০% ইউরেনিয়াম উন্নীত করার গল্প বিশ্বশক্তিগুলোর প্রতারণা ও প্রতিবন্ধকতার এক ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা। আমেরিকা এবং তার মিত্র দেশগুলো পারমাণবিক জ্বালানীর জন্য তেহরানের অত্যাবশ্যক প্রয়োজনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে ইরানের বৈজ্ঞানিক সক্ষমতা সীমিত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ইরানের বিজ্ঞানীরা স্থানীয় জ্ঞান ও সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেন।
ইসলামি বিপ্লবের নেতা বাসিজের সঙ্গে তার সাম্প্রতিক বৈঠকে ইরানের বৈজ্ঞানিক ও পারমাণবিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, "যারা ২০% সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের ব্যাপারে আমেরিকার বিদ্বেষপূর্ণ ষড়যন্ত্র ভেঙ্গে দিতে পেরেছে তারাই বাসিজ।" পার্সটুডের মতে, ফারহিখতেগান পত্রিকাটি এই প্রেক্ষাপটে এবং ইরানের পারমাণবিক সমস্যার ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে লিখেছ, এই বিবৃতিগুলো ১৯৮০ এর দশকের একটি গুরুত্বপূর্ণ গল্পের কথা মনে করিয়ে দেয় যখন ইরান বিশ্বশক্তির নিষেধাজ্ঞা এবং বাধার মুখে বাসিজির উপর নির্ভর করে ইউরেনিয়াম উৎপাদনে বিজ্ঞানীরা ২০ শতাংশ অর্জন করেছেন।
আমেরিকা ইরানের একমাত্র পারমাণবিক জ্বালানী সরবরাহকারীকে বিনিময় অব্যাহত রাখা থেকে বিরত রেখেছে
৮০ এর দশকের শেষের দিকে ইরান একটি গুরুতর সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল। তেহরানের গবেষণা চুল্লি যেটি রেডিওফার্মাসিউটিক্যাল আইসোটোপ এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য ১৯৬০'র দশকে চালু হয়েছিল তার জন্য ২০% সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম জ্বালানীর প্রয়োজন ছিল। এই চুল্লিটি ১৯৬০এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা নির্মিত হয়েছিল এবং বিপ্লবের আগ পর্যন্ত আমেরিকা থেকে এটির জ্বালানি সরবরাহ করেছিল। বিপ্লবের পর ইরান আর্জেন্টিনাসহ অন্যান্য দেশ থেকে এই চাহিদার যোগান দেয়। কিন্তু ২০০৭ সালে ২০% সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুদ শেষ হওয়ার পর ইরান আর্জেন্টিনাকে নতুন জ্বালানি কেনার জন্য অনুরোধ করে। যে আমেরিকা এই ইস্যুটির কৌশলগত গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিল সে আর্জেন্টিনার উপর চাপ সৃষ্টি করে এই দেশটিকে ইরানের চাহিদা পূরণে বাধা দেয়। এই পদক্ষেপ ইরানকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলেছিল যেখানে তাকে তেহরান চুল্লি বন্ধ করতে হয়েছিল বা অন্য সমাধান খুঁজতে হয়েছিল। এই চুল্লি বন্ধ করার অর্থ রেডিওফার্মাসিউটিক্যালস উৎপাদন বন্ধ করা যার ফলে হাজার হাজার রোগীর জীবনকে বিপন্ন করা।
তুরস্ক ও ব্রাজিলের বিপক্ষে ইরানের পদক্ষেপ
এই সমস্যা সমাধানের জন্য ইরান ভিয়েনা গ্রুপের সদস্য দেশগুলো যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং রাশিয়র সাথে আলোচনায় বসে। এই দেশগুলো ইরানের ৩.৫ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ২০% ইউরেনিয়ামের সঙ্গে বিনিময় করার প্রস্তাব করেছিল। এই প্রস্তাব অনুসারে, ইরান রাশিয়ায় ১২০০ কেজি ৩.৫% ইউরেনিয়াম পাঠাবে এবং এক বছর পরে ১২০ কেজি ২০% ইউরেনিয়াম পাবে। কিন্তু ইরান নানা কারণে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। প্রথমত, পশ্চিমা দেশগুলো সময়মতো জ্বালানি সরবরাহের নিশ্চয়তা দেয়নি। দ্বিতীয়ত, বুশেহর পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্পে ফ্রান্সের বিপরীতমুখী আচরনের মতো অতীত অভিজ্ঞতা ইরানের অবিশ্বাসকে শক্তিশালী করেছিল।
ইরান পরামর্শ দিয়েছিল যে এই বিনিময়টি ইরানের মাটিতে বা তুর্কিয়ের মতো তৃতীয় কোনো দেশে করা হোক। এ ব্যাপারে ইরান তেহরানের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকা তুরস্ক ও ব্রাজিলকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করার আমন্ত্রণ জানায়। এই পরিকল্পনা অনুসারে ইরান তুরস্কে ১২০০ কেজি ৩.৫ % সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম পাঠাবে এবং বিনিময়ে ১২০ কেজি ২০% ইউরেনিয়াম পাবে।
আমেরিকা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অসাধু আচরণ তুলে ধরে ইরান তার এজেন্সির সমর্থন নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ২০% ইউরেনিয়াম উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জনমতকে রাজি করানোর ক্ষেত্র তৈরি করেছে। পশ্চিমারা যারা আশা করেনি যে ইরান এত দ্রুত ২০% সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদন প্রযুক্তি অর্জন করতে সক্ষম হবে তারা খুব অবাক হয়েছিল। পশ্চিমা দেশগুলো যারা ইরানকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ দিয়ে তাদের শর্ত মেনে নিতে বাধ্য করার চেষ্টা করছিল তারা এখন এমন একটি দেশের মুখোমুখি হয়েছে যেটি স্বাধীনভাবে তার চাহিদা পূরণ করেছে। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে ইরান ঘোষণা করেছিল যে তারা ২৫ কেজি ২০% ইউরেনিয়াম তৈরি করেছে। এই সংখ্যা প্রতি মাসে বৃদ্ধি পায় এবং ইরান সম্পূর্ণরূপে তার অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়।
শহীদ শাহরিয়ারি পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদনের পথ খুলে দেন
ইরানের ২০% ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রযুক্তির কৃতিত্ব ছিল দেশটির বাসিজ বিজ্ঞানীদের বিশেষ করে শহীদ মাজিদ শাহরিয়ারির সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টার কারণে। শহীদ শাহরিয়ারি দুটি সেন্ট্রিফিউগাল ক্যাসকেড ডিজাইন সংযুক্ত করে ৫% থেকে ২০% পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের জটিল সূত্রটি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হন। এই প্রক্রিয়া, যার জন্য অত্যন্ত উচ্চ নির্ভুলতা এবং নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন পারমাণবিক জ্বালানী উৎপাদনের সবচেয়ে কঠিন পদক্ষেপগুলির মধ্যে একটি। উপরন্তু তিনি জ্বালানী প্লেট তৈরিতে সফল হন যা চুল্লিতে ২০% ইউরেনিয়াম ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনীয়। এই অর্জন ইরানকে পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলে।
একটি ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা
ইরানের ২০% ইউরেনিয়াম পাওয়ার গল্প বিশ্বশক্তির প্রতারণা ও বাধার ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা। আমেরিকা এবং তার মিত্ররা পারমাণবিক জ্বালানীর জন্য তেহরানের অত্যাবশ্যক প্রয়োজনের বিষয়টির ওপর প্রভাব বিস্তার করে ইরানের বৈজ্ঞানিক সক্ষমতা সীমিত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ইরানের বিজ্ঞানীরা অভ্যন্তরীণ জ্ঞান ও শক্তির ওপর ভর করে এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেন। আমেরিকার এই কর্মকাণ্ড দেখায় যে মূল লক্ষ্য ছিল ইরানের সমস্যার সমাধান করা নয় ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা সীমিত করা এবং ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুদ নিষ্কাশন করা। উপরন্তু তুরস্ক এবং ব্রাজিলের মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা দেখিয়েছে যে তাদের সমস্যা সমাধানের আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের চাপের কারণে ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। এই অভিজ্ঞতা বৈশ্বিক কূটনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা রয়েছে। পরিশেষে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে অভ্যন্তরীণ শক্তির উপর নির্ভর করে বাহ্যিক চাপ মোকাবেলার জন্য একটি সর্বোত্তম উপায়। সূত্র: পার্সটুডে
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম