বুধবার,

০১ জানুয়ারি ২০২৫,

১৮ পৌষ ১৪৩১

বুধবার,

০১ জানুয়ারি ২০২৫,

১৮ পৌষ ১৪৩১

Radio Today News

ব্যাটল অব লেইট গালফ: মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নৌ যুদ্ধ

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২২:২৮, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪

Google News
ব্যাটল অব লেইট গালফ: মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নৌ যুদ্ধ

সময়ের সাথে সাথে বদলেছে ভূরাজনীতি, বদলেছে বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের কলাকৌশল। যুদ্ধবিদ্যার ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা ঘটে গেছে যা বর্তমান সময়ে গালগল্পের মতো শোনাবে। তেমনি একটি অবিস্মরণীয় যুদ্ধ হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের  "ব্যাটল অব লেইট গালফ" বা লেইট উপসাগরের যুদ্ধ, যা ছিল মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নৌ যুদ্ধ। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জাপান মিত্রশক্তির পক্ষ নিয়েছিলো, কিন্তু ভূরাজনীতিতে আসলে স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু বলে কিছু নেই। পরিস্থিতি অনুযায়ী পক্ষ বেছে নিতে হয়, তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আগ্রহ ছিলো জার্মানির নেতৃত্বধীন অক্ষশক্তির দিকে।

প্রথম দিকে অক্ষশক্তি দারুণ ভাবে শক্তিমত্তার জানান দেয় এবং যুদ্ধের ময়দানে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করে। অপর দিকে, মিত্রপক্ষের দেশগুলো আক্রমণ সামলে নিয়ে দ্রুতই পাল্টা জবাব দিতে শুরু করে। বিশেষ করে ইউরোপে মিত্রপক্ষের অপারেশন "ওভারলর্ড" কোণঠাসা করে দেয় জার্মানিকে, কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরে তখনও জাপান অক্ষশক্তির শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছিল। তাই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে জাপানকে পরাজিত করতে আমেরিকা বড় একটি নৌযুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। ১৯৪৪ সালের ২৩ থেকে ২৬ অক্টোবর সংঘটিত সেই যুদ্ধকেই বলা হয় "ব্যাটল অফ লেইট গালফ" বা লেইট উপসাগরের যুদ্ধ ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর মাঝে লেইট গালফের যুদ্ধ অন্যতম। প্রায় দুই লাখ নৌ সেনা এতে অংশ নিয়েছিলো। জাপান তাদের বিমান হামলায় বিখ্যাত " কামিকাজে" কৌশল প্রথমবার ব্যবহার করে এই যুদ্ধে। সত্যি বলতে কী, জাপানের পরাজয় অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায় লেইট যুদ্ধের মাধ্যমে । এমনকি এটাও বলা যায় পৃথিবীতে এর আগে কখনো এতো বড় নৌযুদ্ধ সংঘটিত হয়নি।

১৯৩৯ সালে জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করলে ফ্রান্স ও ব্রিটেন এর ঘোর বিরোধিতা করে . তবে তখনও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল অস্পষ্ট। কিন্তু জাপান অক্ষশক্তির পক্ষে যোগ দিয়ে পরের বছরে আক্রমণ করে পার্ল হারবারে। কাজেই যুক্তরাষ্ট্র  বাধ্য হয়েই যুদ্ধে যোগ দেয় মিত্রশক্তির পক্ষে।

যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্তির ফলে ইউরোপের যুদ্ধ অক্ষরিক অর্থেই রূপ নেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। একেবারে শুরুর দিকে ইউরোপে জার্মানির সামনে মিত্রশক্তি দাঁড়াতেই পারছিলো না৷ এমনকি নাৎসি বাহিনী দখল করে নিয়েছিলো ফ্রান্স। অন্যদিকে দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে জাপানকে মোকাবিলা করার মতো অবস্থায়ও ছিলো না মিত্রপক্ষ।
এদিকে পার্ল হারবারে আক্রমণ করে প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকার নৌবাহিনীর কোমর ভেঙে দিয়েছিল জাপান। তবে দ্রুতই মিত্রশক্তি নিজেকেদের সামলে নেয়।

প্রথমদিকে প্রতিরোধে মনোযোগী মিত্রপক্ষ ধীরে ধীরে আক্রমনাত্মক হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ১৯৪৪ সালে নাৎসি বাহিনীর দখল থেকে ফ্রান্সকে মুক্ত করার পর অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থানে চলে আসে মিত্রপক্ষ। পশ্চিম ইউরোপে চরমভাবে ধরাশায়ী হয় অক্ষশক্তি। তখন জাপানও শুরুর দিকে আক্রমনাত্মক অবস্থান থেকে সরে এসে প্রশান্ত মহাসাগরে নিজেদের কব্জায় থাকা অঞ্চলগুলোতে প্রতিরক্ষামূলক নীতি অবলম্বন করে।

এসময় মিত্রপক্ষ ইউরোপে যেহেতু খুব ভালো অবস্থানে ছিলো তাই তারা এবার নজর দেয় দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে। বিশেষ করে জাপানের কাছে হারানো অঞ্চলগুলো ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে তারা এবং পরিকল্পনা করে প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানের ঠিক কোথায় আক্রমণ করলে সহজেই বিজয় অর্জন করা সম্ভব হবে। তবে এই পরিকল্পনা নিয়ে আমেরিকান সমরবিদদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়।

১৯৪৪ সালের পর মিত্রপক্ষ জয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে যায়। যুদ্ধে এমন সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলে প্রতিপক্ষকে যেখানে ইচ্ছা আক্রমণ করা যায়, আমেরিকার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিলো। তারা এতেটাই সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলো যে জাপানের যেকোনো ঘাঁটি আক্রমণ করা ছিলো তাদের ইচ্ছাধীন। এ নিয়ে আমেরিকার সমরবিদরা  আলোচনায় বসেন। তবে তারা একমত হতে পারছিলেন না। আমেরিকার চিফ অফ নেভাল অপারেশন এডমিরাল আর্নেস্ট জে. কিং মত দিয়েছিলেন ফরমোজা দ্বীপে আক্রমণ করতে। এতে করে জাপানের জ্বালানি আমদানির পথে বাধা তৈরি করা যাবে৷

ফরমোজা দ্বীপে হলো আজকের তাইওয়ান। আর্নেস্টের সাথে একমত পোষণ করেন এডমিরাল চেস্টার নিমিত্স। তবে তিনি পাশাপাশি ফিলিপাইনেও আক্রমণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।

অন্যদিকে আর্মির চিফ অফ স্টাফ জর্জ কাটলেট মার্শাল মতামত দেন ফিলিপাইন ও ফরমোজায় আক্রমণ না করে সরাসরি জাপানের হোনশু দ্বীপে আক্রমণ করতে।
কিন্তু আবার আরেক প্রভাবশালী জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থার ফিলিপাইন ছাড়া অন্য কোথাও আক্রমণ করতে চাইছিলেন না।

ফিলিপাইন আক্রমণে ম্যাকআর্থারের অবশ্য ব্যক্তিগত ক্ষোভই ছিলো বেশি। কারণ ১৯৪২ সালে যখন আমেরিকার কাছ জাপান ফিলিপাইনে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় তখন সেখানে দায়িত্বরত ছিলেন ম্যাকআর্থার। আর ফিলিপাইন থেকে তিনি পিছু হঠার সময় বলে এসেছিলেন "আমি আবারও ফিরে আসবো।" 

ম্যাকআর্থারের সিদ্ধান্ত শুধু গতানুগতিক ছিলো না, বরং কৌশলী ছিলো, কারণ তিনি জানতেন প্রথমেই ফরমোজাতে আক্রমণ করলে জাপান ফিলিপাইন থেকে সেখানে সাহায্য পাঠাতে পারবে খুব সহজেই। তাই আগে ফিলিপাইনে জাপানের সবচেয়ে শক্তিশালী নৌঘাঁটি দখল করে নিতে পারলে পরে সহজেই ফরমোজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া যাবে৷ তাই শেষে ম্যাকআর্থারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হয়। তবে দফায় দফায় আলোচনা করতে সময় কেটে যায় প্রায় দুই মাস।

এইদিকে জাপানও টের পেয়ে যায় খুব শীঘ্রই আমেরিকা আক্রমণ করবে তাদের।  জাপান আক্রমণের ব্যাপারে নিশ্চিত হলেও ঠিক কথায় আক্রমণ হবে তা ঠিকঠাক জানতো না ফলে একাধিক পরিকল্পনা হাতে নেয় তারা। শোগো ১,২,৩, ৪  সাংকেতিক নামে চারটি পরিকল্পনা করা হয়।

শোগো ১ হলো যদি তাদের ফিলিপাইনের ঘাঁটিতে আক্রমণ হয় তবে তার পাল্টা জবাবের পরিকল্পনা। শোগো ২ ফরমোজা দ্বীপের আর শোগো ৩ এবং ৪ এ পরিকল্পনা করা হয় অনান্য ঘাঁটিগুলোর ব্যাপারে।

১২ই অক্টোবর ১৯৪৪ আমেরিকান জেনারেল চেস্টার নিমিত্স বেরিয়ে পড়েন ফরমোজা দ্বীপের উদ্দেশ্যে। জাপান ভাবলো যে আক্রমণের আশঙ্কা তারা করেছিলো তা ফরমোজাতেই হবে ।

এটি ছিলো জাপানকে ধোঁকা দেওয়ার কৌশল কিন্তু জাপান কিছু না ভেবেই ফরমোজা প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা শোগো ২ সচল করে দেয় এবং জাপানের ইম্পেরিয়াল নেভি সমস্ত শক্তি দিয়ে জেনারেল নিমিত্সকে আটকানোর চেষ্টা করে কারণ জাপানের যুদ্ধকৌশলই ছিলো আক্রমণ সেখানেই হোক সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিহত করা। প্রশান্ত মহাসাগরে এর আগেও তারা এই কৌশল কাজে লাগিয়ে সফল  হয়েছিলো । তবে এই কৌশলের একটা সমস্যা হলো যখন ক্ষতি হয় তখন তা পোষানোর সুযোগ থাকে না।
জেনারেল নিমিত্স শেষ পর্যন্ত ফরমোজায় গেলেন না, কারণ আমেরিকার পরিকল্পনায় ছিলো একটি নকল আক্রমণের নাটক সাজিয়ে ফিলিপাইনে জাপানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল করে দেওয়া। তারা এটি সফল ভাবে করতেও পেরেছিলো।

জেনারেল নিমিত্সের এ সাজানো অভিযানেও জাপানের ক্ষয়ক্ষতি অবশ্য কম হয়নি। জাপানের প্রায় ৬০০ যুদ্ধবিমান এতে ধ্বংস হয় ফলে ফিলিপাইনে জাপান ইম্পেরিয়াল নেভিকে আকাশ থেকে নিরাপত্তা দেওয়ার মতো আর বেশি জঙ্গি বিমান অবশিষ্ট ছিলো না৷

এরপর ১৯৪৪ সালের ২০ শে অক্টোবর আমেরিকা ফিলিপাইনের লেইট উপসাগরীয় অঞ্চলে নোঙর করার সিদ্ধান্ত নেয়। অবশ্য জাপান তখনো হাল ছেড়ে দেয়নি। শোগো ১ অনুযায়ী ঘুরে দাড়ানোর পরিকল্পনা করে তারা।

জাপানের নৌসেনারা ঠিক করে প্রথমে লেইট উপসাগরে নোঙর করতে দেওয়া হবে আমেরিকানদের। এরপর নোঙর করার সময় আমেরিকান এডমিরাল উইলিয়াম হ্যালসি তার সেনাদলকে পেছন থেকে রক্ষার দায়িত্বে থাকবেন তখন জাপানের ভাইস এডমিরাল ওজাওয়া তার দিকে এগিয়ে যান। হ্যালসি যখন এডমিরাল ওজাওয়ার দিকে এগিয়ে আসবে তখন তিনি অন্যদিকে পালাতে শুরু করবেন, আর এতে করে হ্যালসিও পিছু নিবে ওজাওয়ার। ফলে নোঙর করতে যাওয়া আমেরিকান সৈন্যদের সহায়তা করার মতো কেউ থাকবে না। এই সুযোগে আমেরিকানদের উপর আক্রমণ করবে জাপানিরা।

জাপানিদের পরিকল্পনাও ঠিকঠাক পথে আগাচ্ছিলো, তবে আমেরিকানরা লেইট নোঙর করার আগেই বিমান থেকে সৈকতে ঝাঁকে ঝাঁকে বোমা ফেলে জাপানিদের অবস্থা দুর্বল করে দেয়। ফলে তীরে যেতে আমেরিকান সেনাদের খুব একটা বাঁধার মুখে পড়তে হয়নি।

লেইট উপসাগরে মূল যুদ্ধ শুরু হয় ২৩ অক্টোবর প্রথম প্রহরে- জাপানের ভাইস এডমিরাল তাকেও কুরিতার সাথে আমেরিকার নেভির সম্মুখ লড়াইয়ের মাধ্যমে। এসময় কুরিতার সাথে ছিলো জাপান এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধ জাহাজ " ইয়ামাতো।" কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাপানিরা পরাজিত হয়। জাপানিরা লেইট যুদ্ধে জয়ী হলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হতো।

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের