রোববার,

১৩ এপ্রিল ২০২৫,

৩০ চৈত্র ১৪৩১

রোববার,

১৩ এপ্রিল ২০২৫,

৩০ চৈত্র ১৪৩১

Radio Today News

শুল্ক স্থগিত করার পরও বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা

রেডিওটুডে রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৮:০৯, ১২ এপ্রিল ২০২৫

Google News
শুল্ক স্থগিত করার পরও বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা

ইউক্রেন, গাজা এবং ইয়েমেন যুদ্ধের মধ্যে নতুন এক অর্থনৈতিক যুদ্ধের মুখোমুখি বিশ্ব। সামরিক যুদ্ধ অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কিন্তু অর্থনীতি নিয়েই শুরু হয়েছে বড় যুদ্ধ। কোনো বিশেষজ্ঞ এই যুদ্ধকে অর্থনীতিতে পরমাণু যুদ্ধ বলেও উল্লেখ করেছেন। কেবল পণ্য নয়, ওষুধের ওপরও শুল্ক বাড়ানোর হুমকি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

ফলে এর ভয়াবহতা নিয়েও শঙ্কা বাড়ছে। বিশেষ করে সামরিক ও অর্থনৈতিক উভয় দিক দিয়েই পরাশক্তি হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে শুল্কযুদ্ধ অব্যাহত থাকায় তা পুরো বিশ্বকেই প্রভাবিত করছে। ওয়াশিংটনের পালটা ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রতিশোধ হিসেবে চীন মার্কিন পণ্যে ১২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছে। চীন এই যুদ্ধকে ভয় পায় না বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এর আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনকে মোকাবিলায় গোপন অস্ত্র ব্যবহারেরও হুমকি দিয়েছিলেন।

হঠাত্ করেই বৃহস্পতিবার রাতে হোয়াইট হাউজ জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনা পণ্যে শুল্কের পরিমাণ বেড়ে ১২৫ নয়, ১৪৫ শতাংশ হয়েছে। এরপর চীনও মার্কিন পণ্যে শুল্ক ৮৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করে। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধের প্রকৃতি আরো স্পষ্ট হলো। চীন বলেছে, এরপর যুক্তরাষ্ট্র আবার পালটা শুল্ক দিলে তারা আর এতে সাড়া দেবে না।

দেশটি বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা আরোপিত অস্বাভাবিকভাবে উচ্চ শুল্ক আরোপের বিষয়টি আন্তর্জাতিক এবং অর্থনৈতিক বাণিজ্যের নিয়মনীতি, মৌলিক অর্থনৈতিক আইন এবং সাধারণ জ্ঞানকে গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পণ্য রপ্তানির ওপর আরোপিত শুল্ক অর্থনীতিতে বাস্তবিক কোনো তাত্পর্য ছাড়াই একটি সংখ্যার খেলায় পরিণত হয়েছে। তিনি আরো বলেছেন, বারবার শুল্ক বৃদ্ধি কেবল যুক্তরাষ্ট্রের গুন্ডামি এবং জবরদস্তিকে আরো উন্মোচিত করবে। এটি একটি রসিকতায় পরিণত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কযুদ্ধ মোকাবিলায় ইউরোপকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে চীন।

দুই পরাশক্তির যুদ্ধ বিশ্বকে যেভাবে প্রভাবিত করবে

গত বছর যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে ৫৮৫ বিলিয়ন ডলারের (প্রায় ৭২ লাখ কোটি টাকা) বাণিজ্য হয়েছিল। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে ৪৪০ বিলিয়ন ডলারের এবং চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৪৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল। ফলে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ২৯৫ বিলিয়ন ডলার যা মার্কিন অর্থনীতির এক শতাংশের সমপরিমাণ। মার্কিন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিশনের সূত্র মতে, যুক্তরাষ্ট্র চীনে সয়াবিন, এয়ারক্রাফট অ্যান্ড ইঞ্জিন, ইনটেগ্রেটেড সার্কিটস, ফার্মাসিউটিক্যালস ও পেট্রোলিয়াম এবং চীন যুক্তরাষ্ট্রে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ব্যাটারি, খেলনা ও টেলিকম যন্ত্রপাতি রপ্তানি করে। আইএমএফ এর তথ্যানুসারে, চলতি বছরে বিশ্ব অর্থনীতিতে দুই পরাশক্তির অবদান ৪৩ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছে, এই দুই দেশ যদি বাণিজ্যযুদ্ধে লিপ্ত থাকে তাহলে বিশ্ব অর্থনীতি এর কঠোর প্রতিক্রিয়ার শিকার হবে। বৈশ্বিক বিনিয়োগও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ চীন বিশ্বের সর্বোচ্চ পণ্য উত্পাদনকারী দেশ। দেশটির নাগরিকরা এর সামান্য অংশই ভোগ করেন। জানা যায়, চীন ১ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য অতিরিক্ত উত্পাদন করে। এসব পণ্য বিশ্বের অন্যান্য দেশে রপ্তানি করা হয়। চীন কেবল নিজ দেশেই পণ্য রপ্তানি করে না, অন্যান্য দেশেও এর কারখানা রয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানি কমে গেলে উত্পাদন কমে যাওয়ায় শ্রমিক এবং শ্রমমূল্যের ওপর প্রভাব ফেলবে।

মন্দার আশঙ্কা কাটছে না

বাণিজ্যযুদ্ধ এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে ট্রাম্পের সমর্থক ধনকুবের বিনিয়োগকারী বিল অকম্যান সতর্ক করে বলেন, নতুন শুল্কারোপ নিয়ে সামনে অগ্রসর হলে সেটা ‘অর্থনৈতিক পরমাণবিক যুদ্ধ’ শুরু করার শামিল হবে। এরপর একদিন পরই চীন ছাড়া বাকি দেশের জন্য বাড়তি শুল্কনীতি ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেন ট্রাম্প। তার এই সিদ্ধান্তেও আর্থিক মন্দা কাটবে না বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বিশ্বের অন্যতম ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং সংস্থা জেপি মর্গ্যান চেজ জানিয়েছে, ট্রাম্পের নীতির ফলে আগামী দিনে ৬০ শতাংশ মন্দার মুখ দেখতে চলেছে বিশ্ব। আন্তর্দেশীয় বাণিজ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন নীতিতে বারবার রদবদলের প্রভাব পড়তে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ আর্থিক বিকাশে যা শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, বরং বিশ্বব্যাপী মন্দার জন্ম দিতে পারে। জেপি মর্গ্যান ছাড়াও মার্কিন পরামর্শদাতা সংস্থা আরএসএম ইউএস এর প্রধান অর্থনীতিবিদ জো ব্রুসুয়েলাস সতর্ক করে বলেন, সাময়িক স্থগিতাদেশ মন্দা রোধে যথেষ্ট নাও হতে পারে।

গোল্ডম্যান স্যাক্সের অর্থনীতিবিদরাও আগামী ১২ মাসে অন্তত ৪৫ শতাংশ মন্দার পূর্বাভাস দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা আরো জানিয়েছেন, এখনো ১০ শতাংশ সর্বজনীন শুল্ক আগের মতোই বহাল, যা বিশ্ব বাজারে বড় ধাক্কা দিতে পারে। এই ধাক্কা হতে পারে ২০১৮-১৯ সালের বাণিজ্যযুদ্ধের ধাক্কার ৭ দশমিক ৫ গুণের সমান। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘বাণিজ্যযুদ্ধ শেষ হয়নি, বরং এটা কেবল শুরুর শেষ।’ কারণ বিশ্ব শেয়ার বাজারে সূচকের পতন গতকাল শুক্রবারও অব্যাহত ছিল। এমনকি গত তিন বছরে প্রথম বারের মতো ইউরোর বিপরীতে ডলারের মূল্য কমেছে।

শুল্কযুদ্ধ শুরু যেভাবে

স্টিফেন মিরান। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ। এই মিরানই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পারস্পরিক শুল্কের প্রকৃত পরিকল্পনাকারী বলে মনে করা হচ্ছে। ২০২৪ সালের ২২ ডিসেম্বর স্টিফেনকে ট্রাম্পের ‘কাউন্সিল অব ইকনোমিক অ্যাডভাইসার্স’ এর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি প্রেসিডেন্টের শুল্ককেন্দ্রিক বাণিজ্য নীতির অন্যতম পরামর্শদাতা। গত নভেম্বরে স্টিফেন ৪১ পাতার ‘বিশ্বব্যাপী ট্রেডিং সিস্টেম পুনর্গঠনের জন্য ব্যবহারকারীর নির্দেশিকা’ রচনা করেন।

এই নির্দেশিকাকেই মাথায় রেখেই শুল্কনীতির পরিকল্পনা করে ট্রাম্প প্রশাসন। নির্দেশিকাটিতে দাবি করা হয়েছে, শুল্ককে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে অন্যান্য দেশের বাজারে মার্কিন পণ্য রপ্তানির নিরাপদ প্রবেশাধিকারের শর্ত তৈরি করবে। এরপর সেই নির্দেশিকা মেনেই এগিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম্প। এশিয়া তো বটেই, ট্রাম্পের রোষানল থেকে রেহাই পায়নি প্রধান মিত্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোও। ইইউভুক্ত দেশগুলোর উপর ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করেছে আমেরিকা।

এই কর প্রযোজ্য হচ্ছে ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম, গাড়িসহ আরো নানা সামগ্রীতে। এর পাশাপাশি ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে আরো বহু পণ্যে। যদিও গত ৯ এপ্রিল গভীর রাতে বর্ধিত শুল্কহার আপাতত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

রেডিওটুডে নিউজ/আনাম

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের