‘আলু আবাদ করি এবার হামার কোমর পড়ি গেইল বাহে। ৫২ টাকা কেজি দরে বীজ কিনি আলু গাড়নো (রোপণ), সেই আলু বেচা নাগোচে ১৫ টাকা কেজি দরে। এই লোকসান পূরণ হবার নয়। মরণ ছাড়া হামার কৃষকের কোনো পথ নাই।’
রংপুরের তিস্তার চরে আগাম রোপণ করা আলু ১৫ টাকা কেজি দরে বিক্রির প্রাক্কালে অপূরণীয় ক্ষতি হওয়ায় এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন গান্নারপার এলাকার কৃষক অহেদুল ইসলাম। শুধু তিনিই নন, আগাম আলুর বাজারে ধস নামায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষক।
আলু চাষের কেন্দ্র রংপুরেই গেল বছর আলু কিনে খেতে হয়েছে ৮০ টাকা কেজি দরে। এ বছর রোপণ মৌসুমে বেশি দামে বীজ কিনে একবুক আশা নিয়ে কৃষকরা আলু চাষ করেন। কিন্তু আগাম নতুন আলুর বাজারে হঠাৎ ধস নামায় বড় লোকসান শুনতে হচ্ছে তাদের।
কৃষকরা জানান, বীজ, সার ও কীটনাশকের দাম বেড়ে যাওয়ায় আলু চাষে খরচ অনেক বেড়েছে। ভরা মৌসুমে আলুর দাম কমে যাওয়ার ভয়সহ চলতি শৈত্যপ্রবাহের কারণে রয়েছে ক্ষতির শঙ্কাও। এ কারণে আগাম রোপণ করা আলু বিক্রি না করে উপায় নেই। কিন্তু হঠাৎ দাম কমে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ তো উঠছেই না, বরং বিঘাপ্রতি প্রায় ২২ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলায় এ বছর ১ লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে আলুর চাষ হয়েছে। এর মধ্যে তিস্তার চরাঞ্চলসহ রংপুর জেলাতেই চাষ হয়েছে ৫৫ হাজার ৪৩৫ হেক্টর জমিতে। যার মধ্যে আগাম আলুর চাষ হয়েছে অন্তত ১২ হাজার হেক্টর জমিতে। সব মিলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫ লাখ টন আলু।
সরেজমিন গতকাল শুক্রবার তিস্তার চরাঞ্চল রংপুরের মহিপুর, গান্নারপার, পূর্ব ইছলী ও ছালাপাক এলাকায় দেখা যায়, মাঠজুড়ে আলু ক্ষেতের মাঝে মাঝে আগাম রোপণ করা আলু তোলার ধুম পড়েছে।
পূর্ব ইছলী এলাকার নাদের আলী তিন বিঘা জমিতে গ্রানুলা জাতের আলু লাগিয়েছেন। ১৫ টাকা কেজি দরে সমুদয় আলু স্থানীয় পাইকারের কাছে বিক্রি করেন তিনি। খরচের হিসাব কষে তিনি জানান, এক বিঘা (৩৩ শতক) জমিতে ৫২ টাকা কেজি দরে ২০০ কেজি বীজ রোপণ করতে ১০ হাজার ৪০০ টাকা খরচ হয়েছে। সার, কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, সেচসহ আলু তোলা পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। তিন মাসের জন্য জমি লিজ বাবদ দিতে হয়েছে আরও ৬ হাজার টাকা। সব মিলে খরচ হয়েছে ৫১ হাজার ৪০০ টাকা। প্রতি শতকে এক বস্তা (৬০ কেজি) আলু হিসেবে বিঘায় উৎপাদন হয়েছে ১ হাজার ৯৮০ কেজি। ১৫ টাকা কেজি হিসাবে যার মূল্য দাঁড়ায় ২৯ হাজার ৭০০ টাকা।
মহিপুর চরের সোনা মিয়া ও আব্দুল হামিদ বলেন, ‘আগাম আলুতে প্রত্যেক বছরে ভালো লাভ হয়। এইবারে পরথম ধরা খাইনো।’ তিস্তা সেতু এলাকার দু’পাশে আলুর বস্তা স্তূপ করে রাখা হয়েছে। ট্রাকযোগে সেগুলো ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানোর অপেক্ষায়। মহিপুর এলাকার স্থানীয় পাইকার আজিজার রহমান, সুরুজ আলী ও নয়া মিয়া জানান, আলুর বস্তা প্রস্তুত হলে প্রতি ট্রাকে ২২০ বস্তা আলু (১৫ টন) তুলে দেওয়া হয়। খরচ বাদ দিয়ে প্রতি কেজি আলুতে ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা লাভ হয়। স্থানীয় পাইকাররা জানান, ঢাকার পাইকাররা এলাকায় আসেন না। প্রতিদিন মোবাইল ফোনে চুক্তি অনুযায়ী টাকা দিলে তাদের কাছে আলু পাঠানো হয়। সূত্র: সমকাল