চাঁদপুরের হাইমচরে মেঘনা নদীতে সারবহনকারী এমভি আল বাখেরা জাহাজে ৭ জন খুনের ঘটনায় রহস্য উদঘাটন হয়েছেন বলে জানিয়েছেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস। এ ঘটনায় আকাশ মন্ডল ইরফান নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস সমকালকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বেতন ভাতা না পাওয়া ও দুর্ব্যবহারের ক্ষোভ থেকে আকাশ মন্ডল ইরফান জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়াকে হত্যা করেন। এছাড়া মাস্টারকে খুনের তথ্য জাহাজে থাকা বাকিরা জেনে গেলে তিনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ধরা পড়বে বিধায় একে একে সবাইকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করেন।
জানা যায়, আকাশ মন্ডল ইরফান বাগেরহাটের ফকিরহাট এলাকার জগদীশ মন্ডলের ছেলে। তিনি সুকানির সঙ্গে ইঞ্জিনরুমে কাজ করতেন।
গ্রেপ্তারের সময় আকাশ মন্ডল ইরফানের কাছে থেকে ১টি হ্যান্ডগ্লাভস, ১টি লোটো ব্যাগ, ঘুমের ওষুধের খালি পাতা, নিহতদের ব্যবহৃত ৫টি ও গ্রেপ্তার আকাশের ব্যবহৃত ২টিসহ মোট ৭টি মোবাইল এবং বিভিন্ন জায়গায় রক্ত মাখানো নীল রংয়ের ০১টি জিন্স প্যান্ট উদ্ধার করা হয়।
খুন হওয়া ব্যক্তিরা হলেন- মাস্টার গোলাম কিবরিয়া, গ্রিজার সজিবুল ইসলাম, লস্কর মাজেদুল ইসলাম, শেখ সবুজ, আমিনুর মুন্সী, ইঞ্জিন চালক সালাউদ্দিন ও বাবুর্চি রানা কাজী। এ ছাড়া আহত ব্যক্তি হলেন- সুকানি জুয়েল।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য দিয়ে র্যাব দাবি করে, ইরফান প্রায় ৮ মাস ধরে এমভি-আল বাখেরা জাহাজে চাকুরি করে আসছে। ওই জাহাজের কর্মচারীরা ছুটি ও বেতন-বোনাস সময় মতো পেত না এবং বিভিন্ন ধরনের বিল কর্মচারীদের না দিয়ে জাহাজের মাস্টার একাই ভোগ করত বলে গ্রেপ্তার আকাশ জানায়। তিনি আরও জানান, জাহাজের মাস্টার সব কর্মচারীর ওপর বিনা কারণে রাগারাগি করত এবং কারোর ওপর নাখোশ হলে তাকে কোনো বিচার বিবেচনা ছাড়াই জাহাজ থেকে নামিয়ে দিত এমনকি তাদের বকেয়া বেতনও দিত না। এ ব্যাপারে গ্রেপ্তার আসামি ইরফান জাহাজের সবাইকে প্রতিবাদ করতে বললে কেউ ভয়ে প্রতিবাদ করত না। মাস্টারের এমন কার্যকলাপের কারণে তার মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং এই ক্ষোভ থেকে তাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী আনুমানিক ১৮ ডিসেম্বর ইরফান ৩ পাতা ঘুমের ওষুধ কিনে নিজের কাছে রেখে দেন।
প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদে এ ঘটনায় তিনি একাই জড়িত বলে জানা যায়। পরবর্তীতে অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে বিষয়টি আরো নিশ্চিত হওয়া যাবে।
র্যাব দাবি করে বলে, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রেপ্তার আকাশ ঘটনার দিন সন্ধ্যায় জাহাজে রাতের খাবারের তরকারির মধ্যে ৩ পাতা ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয়। শুধু সুকানি জুয়েল এবং গ্রেপ্তার আকাশ ছাড়া সবাই রাতের খাবার খেয়ে তাদের নিজস্ব কেবিনে ঘুমিয়ে পড়ে। রাত আনুমানিক ২টার দিকে সাহারা বিকন এলাকায় আরও ৮-১০টি জাহাজের সঙ্গে সুকানি জুয়েল এবং গ্রেপ্তার আকাশ তাদের জাহাজটি নোঙ্গর করে। পরবর্তীতে সুকানি জুয়েল রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে আকাশ তার পরিকল্পনা মোতাবেক আনুমানিক রাত ৩টার দিকে প্রথমে মাস্টারকে জাহাজে থাকা চাইনিজ কোড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। পরবর্তীতে সে চিন্তা ভাবনা করে যে, জাহাজে থাকা বাকিরা জেনে গেলে সে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ধরা পড়বে বিধায় একে একে সবাইকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করে। পরবর্তীতে আনুমানিক ভোর সাড়ে ৫টার দিকে সব জাহাজ তাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেলে সে নিজে জাহাজ চালাতে থাকে এবং এক পর্যায়ে মাঝিরচর নামক এলাকায় জাহাজটি আটকা পড়লে পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ট্রলারে বাজার করার কথা বলে ট্রলারে উঠে পালিয়ে যায়। তিনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেপ্তার এড়াতে বাগেরহাটে চিতলমারি এলাকায় আত্মগোপনে চলে যায়। পরবর্তীতে আত্মগোপনে থাকাবস্থায় র্যাব তাকে গ্রেপ্তার করে।
এদিকে চাঁদপুরের হাইমচরে মেঘনা নদীতে সারবহনকারী এমভি আল বাখেরা জাহাজে ৭ জন খুনের ঘটনায় মামলা হয়েছে। মামলায় আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতনামা ‘ডাকাত দলকে’। মঙ্গলবার রাতে হাইমচর থানায় মামলাটি করেন জাহাজের মালিক মাহাবুব মুর্শেদ। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন হাইমচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মহিউদ্দিন সুমন।
এর আগে গত সোমবার চাঁদপুরের মেঘনা নদীর হাইমচর উপজেলার ইশানবালা এলাকায় এমভি আল-বাখেরা নামে সারবাহী একটি জাহাজ থেকে ৫ জনকে মৃত ও ৩ জনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ২ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
পণ্যবাহী জাহাজটি গত রোববার সকাল ৮টার দিকে চট্টগ্রামের কাফকো সার কারখানার ঘাট থেকে যাত্রা করে। এরমধ্যে কোম্পানির মালিক শিপন বাখেরা জাহাজে ফোন করে কাউকে পাননি। এতে সন্দেহ হয় মালিকপক্ষের। জাহাজের অবস্থান এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে জেনে মেসার্স বৃষ্টি এন্টারপ্রাইজের অন্য জাহাজ মুগনি-৩ থেকে যোগাযোগ করার জন্য বলা হয়। ওই সময় মুগনি-৩ জাহাজটি মাওয়া থেকে ঘটনাস্থল দিয়ে অতিক্রম করার সময় বাখেরা নামক জাহাজটিকে দেখতে পায়। ওই সময় তারা জাহাজের লোকদের রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল দেন। ফোন পেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জাহাজ থেকে নিহত ও আহতদের উদ্ধার করেন। তারা যখন জাহাজটিতে উঠেছিলেন, তখন ইঞ্জিন বন্ধ ছিল।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম