সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার প্রত্যন্ত গ্রামে মহিলাদের জীবন সবসময় অবহেলিত ছিল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মহিলা কৃষকরা তাদের পালিত গরু থেকে তাজা দুধ সংগ্রহ করে আসছে। দুধ সংগ্রহের জন্য তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছে। কিন্তু, তাদের কঠোর পরিশ্রমের সত্ত্বেও, তাদের দুধের জন্য একটি স্থায়ী বাজার খুঁজে পেতে নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। প্রায় তারা কম দামে দুধ বিক্রি করতে বাধ্য হয়। কখনো বা দূরে গিয়ে বিক্রি করতে হতো, কখনো আবার ক্রেতা না পেলে দুধ ফেলে দিতে হতো।
‘গ্রামীণ ডানোন ফুডস লিমিটেড’ ও ‘হেইফার ইন্টারন্যাশনাল’ একসাথে ‘দ্যা মিল্ক ফর স্কুল প্রোগ্রাম’ নামের একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে। তখন থেকেই প্রত্যন্ত এসব অঞ্চলের চিত্র পাল্টাতে শুরু করে। এই উদ্যোগের পর থেকে সেই এলাকায় শুধু মহিলাদের জীবন নয়, গ্রামের শিশুদের জীবন ও স্বাস্থ্যও বদলাতে শুরু করে।
‘মিল্ক ফর স্কুল প্রোগ্রাম' এই উদ্যোগটি প্রাথমিকভাবে শুরু হলেও এর পিছনের লক্ষ্য ছিল দূরদর্শী। স্থানীয় মহিলাদের জন্য আয়ের উৎস তৈরি করে শিক্ষার্থীদের পুষ্টিকর দুগ্ধজাত পণ্য সরবরাহ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করে তারা। এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে, গ্রামীণ ডানোন উল্লাপাড়ায় একটি মিল্ক চিলিং সেন্টার নির্মাণ করে, যেখানে মহিলা কৃষকরা ন্যায্য মূল্যে তাদের দুধ বিক্রি করতে পারে।
মিল্ক চিলিং সেন্টারটি অনেক নারীর জন্য নতুন ভোর হয়ে উদয় হয়। যেখানে আগে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় দিন কাটাতে হতো সেখানে আজ তারা দুধ বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে।
মহিলা কৃষকদের থেকে ক্রয় করা দুধ সংগ্রহ করে শক্তি+ ফর্টিফায়েড দই বানানো হয় যেগুলো পুষ্টি সমৃদ্ধ। শক্তি+ দইসমূহ বাচ্চা ও বড়দের পুষ্টি সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকে। প্রতি কাপ দই দৈনিক চাহিদার সর্বোচ্চ ৩০% পর্যন্ত পুষ্টি প্রদান করে থাকে। সেই দই বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করা হয়। পাশাপাশি 'মিল্ক ফর স্কুল প্রোগ্রাম'-এর মাধ্যমে উল্লাপাড়ার এক হাজার শিশুকে প্রতিদিন পুষ্টিসমৃদ্ধ এই দই বিনামূল্যে দেয়া হয়।
উল্লাপাড়ার শিশুদের উপর এর প্রভাব অভূতপূর্ব। দরিদ্র একটি গ্রামে যেখানে অনেক পরিবারের পুষ্টিকর খাবারের কমতি ছিল সেখানে বিনামূল্যে এই দই পুষ্টির জন্য একটি নির্ভরযোগ্য উৎস হয়ে উঠেছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় সেখানকার স্কুলগুলোতে। এই প্রকল্পের আগে, গ্রামের স্কুলে উপস্থিতির হার ছিল ৭৬%, এই উদ্যোগ গ্রহণ করার পরে, ২০২৩ সালের শেষের দিকে উপস্থিতি বেড়ে ৯২% এ উন্নীত হয় এবং ২০২৪ সালের প্রথম দিকে তা ৯৪% এ পৌঁছে যায়। শুধু তাই নয়, এই উদ্যোগটি আশেপাশের এলাকার শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করে, ফলে স্কুলগুলো প্রাণবন্ত শিক্ষার কেন্দ্রে পরিণত হয়।
গ্রামীণ ডানোন এবং হেইফার ইন্টারন্যাশনাল এর 'মিল্ক ফর স্কুল প্রোগ্রামটি' শুধুমাত্র বাচ্চাদের পুষ্টি প্রদানের উদ্যোগে সীমাবদ্ধ ছিল না, এর উদ্দেশ্য ছিল সুদূরপ্রসারী। এটি একটি সমগ্র সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়নের জন্য রূপায়িত, কিভাবে নারী খামারিদের স্বাবলম্বী করা যায়, শিশুদের শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যায়, সর্বোপরি কীভাবে নানা প্রশিক্ষণ এবং সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে একটি অঞ্চলকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করা যায়, এটি ছিল তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। কারণ, যখন সমাজ বদলের আকাঙ্ক্ষার সাথে যুক্ত হয় সম্মিলিত উদ্যোগ, তখনি স্বপ্ন জয়ের শক্তি বদলে দেয় পৃথিবী।
এমএমএইচ/রেডিওটুডে