পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে ঢাকাসহ সারাদেশে সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরির অভিযোগ উঠেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি সিন্ডিকেট অতিরিক্ত মুনাফার উদ্দেশ্যে মিল পর্যায় থেকে তেলের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে ডিলারদের কাছে তেলের প্রাপ্যতা কমে গেছে, যার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও।
ফলে খুচরা বিক্রেতারা চাহিদা অনুযায়ী তেল পাচ্ছেন না এবং বাড়তি দামেও ক্রেতাদের চাহিদা পূরণ করতে পারছেন না। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এই সংকট সিন্ডিকেটের উদ্দেশ্যমূলক কার্যক্রমের ফল এবং রমজান উপলক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
শুক্রবার (৬ ডিসেম্বর) সরেজমিনে রাজধানীর একাধিক বাজারের মুদি দোকান ঘুরে দেখা যায়, সয়াবিন তেলের এই সংকটে বিপাকে পড়েছেন ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই। বেশিরভাগ দোকানে বোতলজাত ভোজ্যতেল নেই। এক-দুই বা তিন লিটারের বোতলজাত তেল পাওয়া গেলেও পাঁচ লিটারের তেল খুবই সীমিত। অনেক দোকানি শুধু নিয়মিত ও পরিচিত ক্রেতাদের কাছে তেল বিক্রি করছেন। সংকট দেখিয়ে ভোক্তার কাছে অতিরিক্ত দাম নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে খোলা বা লুজ তেল বিক্রি করছেন অনেক দোকানি। তবে অনেক দোকানে সূর্যমুখী ও রাইস ব্র্যান তেল (চালের কুড়ার তেল) পাওয়া যাচ্ছে। সয়াবিনের সংকটে এসব তেলের চাহিদা বেড়েছে।
বাজারে খুচরা বিক্রেতারা জানান, সংকট দেখিয়ে এক সপ্তাহের ব্যবধানে খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েল লিটারপ্রতি ৫ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে খোলা পাম অয়েল ১৬০-১৬২ এবং সয়াবিন ১৭০-১৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর দু-একটি দোকানে এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন মিললেও বিক্রি হচ্ছে ১৬৭-১৭০ টাকায়। এছাড়া দু-এক জায়গায় এই একই তেল ১৭৫-১৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
নয়াবাজারে তেল কিনতে এসেছেন মো. শাকিল। তিনি জানান, বাজার ঘুরে বোতল তেল পাইনি। তাই বাধ্য হয়ে খোলা সয়াবিন তেল কিনতে হচ্ছে। একই বাজারে তেল কিনতে আসা আসমা বেগম বলেন, বোতলজাত সয়াবিন তেল না পাওয়ায় রাইস ব্র্যান তেল নিয়ে বাড়ি ফিরছি।
রামপুরা বাজারে তেল কিনতে আসা মো. একরামুল হক বলেন, বাজার করতে আসা অনেক ক্রেতাই তেল কিনতে এসে খালি হাতেই ফিরছেন। কেউ কেউ সয়াবিন তেল না পেয়ে কিনে নিচ্ছেন রাইস ব্র্যান তেল। এলাকার দোকানেও তেল নেই, বাজারেও নেই। তাহলে আমরা কোথা থেকে কিনবো? বেশ কয়েকদিন ধরেই সয়াবিন তেল নিয়ে এমন ভোগান্তির মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।
রাজধানীর জিনজিরা কাঁচাবাজারের মুদি বিক্রেতা সোহেল জানান, বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া নিম্নবিত্ত ও খেটে খাওয়া মানুষ একবারে বেশি দাম দিয়ে এক লিটারের বোতলজাত তেলও কিনতে পারছেন না। এতে খোলা তেলের চাহিদাও বেড়েছে। ফলে কিছু বিক্রেতা খোলা তেলের দাম বেশি হওয়ায় বোতলজাত তেলের মুখ খুলে খোলা তেলের ড্রামে ঢেলে বিক্রি করছেন। এতে বাজারে বোতলজাত তেলেরও সংকট দেখা দিয়েছে।
দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে বিভিন্ন তেল কোম্পানির ডিলাররা জানান, কোম্পানি থেকে আমাদের তেল সরবরাহ করছে না। যেখানে একজন ডিলারের চাহিদা ১০০ কার্টন, সেখানে কোম্পানি ১০-২০ কার্টন তেল দিচ্ছে। এ কারণে বাজারে সরবরাহ কমাতে হচ্ছে।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, একাধিক কারণে ভোজ্যতেলের বাজার অস্থির। দেশে ডলার সংকট এখনও চলমান রয়েছে। আমদানিকারকরা আগের মতো ভোজ্যতেল আমদানি করছেন না। বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দামও আগের চেয়ে বেড়েছে। এসব কারণে ভোজ্যতেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। দেশের ইতিহাসে পাম অয়েলের দাম এবারের মতো আর বাড়েনি। মূলত ইন্দোনেশিয়ায় উৎপাদন সংকট, বায়োডিজেলে পাম অয়েল ব্যবহারের পরিমাণ ৫ শতাংশ বৃদ্ধিজনিত কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির বুকিং রেকর্ড পরিমাণে বেড়ে গেছে। এসব কারণে ভোজ্যতেলে বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না।
জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, রোজা ঘিরে কয়েক বছর ধরে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট একটি পন্থা অবলম্বন করছে। রোজায় দাম না বাড়িয়ে রোজা শুরুর ৩ থেকে ৪ মাস আগেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে রাখছে। এতে রোজায় ক্রেতারা বাড়তি দরেই পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। আর অতি মুনাফা লুফে নিচ্ছে সেই চিরচেনা সিন্ডিকেট। এখন থেকেই কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে।
যদিও বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার কারণে তেল সরবরাহ কমেছে বলে দাবি তেল আমদানিকারক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর। তারা বলছেন, বিশ্ববাজারের হিসাবে লিটারে ১০-১৩ টাকা বেড়েছে। এ জন্য চাহিদার তুলনায় আমদানি কমেছে ২০ শতাংশের মতো। তাই রিফাইনিং করে তেল বাজারে সরবরাহ কম করে দিতে হচ্ছে।